
খান মুহাম্মদ রুমেল
ছবি : সংগৃহীত
শেষ হলো বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় সম্মেলন। টানা দশমবারের মতো সভাপতি নির্বাচিত হলেন শেখ হাসিনা। আর ওবায়দুল কাদের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে হ্যাটট্রিক করলেন। অনুমিতভাবেই কেন্দ্রীয় কমিটিতে খুব বেশি পরিবর্তন আসেনি।
নির্বাচনের বছরে পরীক্ষিত নেতৃত্বে কোনো রাজনৈতিক দলই খু্ব বেশি পরিবর্তন আনে না। আনার কথাও নয়। আওয়ামী লীগও সেই পথে হেঁটেছে এবং সেটি খুবই স্বাভাবিক।
বাংলাদেশের ঐতিহ্যের সঙ্গে, বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে নাড়ির সম্পর্ক আওয়ামী লীগের। পাকিস্তানি শোষণ-শাসনের বিরুদ্ধে মাত্র ২৪ বছরের সংগ্রামে একটি স্বাধীন দেশের অভ্যুদয়ে নেতৃত্ব দেওয়া রাজনৈতিক দল বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। এখানেই আওয়ামী লীগ অনন্য। এখানেই আওয়ামী লীগ অন্য রাজনৈতিক দলগুলো থেকে আলাদা।
বাংলাদেশের একেবারে প্রান্তিক মানুষের মনের ভেতর থেকে গড়ে ওঠা দল আওয়ামী লীগের কাছে প্রত্যাশাও খুব বেশি। অনেক অনেক বেশি। কিন্তু আওয়ামী লীগ কি মানুষের সেই প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে? কতটা পারছে? এই আলোচনা ঘুরে ফিরে আসছে কিছুদিন ধরে।
২০০৯ সাল থেকে দল টানা ক্ষমতায় আছে। স্বাধীন বাংলাদেশের অর্ধশতকের ইতিহাসে টানা তিনবার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব আর কোনো রাজনৈতিক দল পায়নি। এটি আওয়ামী লীগের জন্য একদিকে যেমন অর্জন, অন্যদিকে দলের প্রতি মানুষের প্রত্যাশার চাপ বাড়িয়েছে অনেক।
১৯৮১ সালের ১৭ মে এক বৃষ্টির দিনে দেশে এলেন শেখ হাসিনা। সামরিক শাসক সেদিন তাকে পিতার স্মৃতি বিজড়িত, ঢাকায় তাদের একমাত্র বাসস্থান ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতেও ঢুকতে দেয়নি। অবশেষে বন্ধুর পথ পাড়ি দিলেন শেখ হাসিনা। দু’দুটি সামরিক শাসন মোকাবিলা করলেন। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র উদ্ধার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিলেন।
বাংলাদেশের ঐতিহ্যের সঙ্গে, বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে নাড়ির সম্পর্ক আওয়ামী লীগের। পাকিস্তানি শোষণ-শাসনের বিরুদ্ধে মাত্র ২৪ বছরের সংগ্রামে একটি স্বাধীন দেশের অভ্যুদয়ে নেতৃত্ব দেওয়া রাজনৈতিক দল বিশ্ব ইতিহাসে বিরল।
১৯৯১-এর নির্বাচনে জনগণ ভোটের মাধ্যমে প্রধান বিরোধীদলের আসনে বসালেন শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগকে। ১৯৯৬-এর নির্বাচনে ২১ বছর পর সরকার গঠন করলো আওয়ামী লীগ। পরের মেয়াদেই আবার বিরোধী দলের আসন। অবশেষে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়কের আমলে জেল জুলুমের পর নির্বাচনের মাধ্যমে আবারও ক্ষমতায় এলো বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার কথা। শেখ হাসিনা সেটি করে দেখিয়েছেন। এরপর ২০১৪ সালের নির্বাচনে এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনেও জয় পায় আওয়ামী লীগ।
নির্বাচনী অঙ্গীকার ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত করেছেন বাংলাদেশকে। মঙ্গা দূর করেছেন। দারিদ্র্যের হার কমিয়েছেন উল্লেখযোগ্য হারে। দেশে উন্নয়ন হয়েছে ব্যাপক। বিশেষ করে অবকাঠামোগত উন্নয়ন।
স্বপ্নের পদ্মাসেতু হয়েছে নিজের টাকায়। দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে এক রকম বিচ্ছিন্ন ছিল দক্ষিণবঙ্গ। এখন তিনঘণ্টা কিংবা আরও কম সময়ে ঢাকা থেকে চলে যাওয়া যায় বরিশাল কিংবা দক্ষিণের যেকোনো জেলায়।
সবই আওয়ামী লীগ সরকারের অর্জন। আরও নির্দিষ্ট করে বললে শেখ হাসিনা দূরদর্শী সিদ্ধান্তের ফসল। সাহসিকতার ফসল। তীব্র দেশপ্রেমের ফসল। কিন্তু এসবের মাঝেও থেকে যায় কিছু কথা।
এই সময়ে দেশ থেকে পাচার হয়েছে বিপুল পরিমাণ টাকা। হাজার হাজার নয়, লাখ লাখ নয়, কোটি কোটি পাচার হয়ে গেছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। যার একটি টাকাও এখনো দেশে ফেরত আনা সম্ভব হয়নি। এমনকি কারা কারা পাচার করেছেন এত এত টাকা তারও নির্দিষ্ট জবাব এখনো জানতে পারেননি দেশের মানুষ।
বাতাসে কান পাতলে শোনা যায় সরকারি দলের কাছের লোকজনের নাম। শোনা যায় আমলাদের নাম। কিন্তু বাতাসের কথা বাতাসে মিলিয়ে যায়। তাতে তো আর বিশ্বাস স্থাপন করা যায় না! ফলে দেশের মানুষ চেয়ে থাকে। আশায় আশায় দিন গোনে। এদিকে নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে থাকে জ্যামিতিক হারে।
ভোটের রাজনীতির মারপ্যাঁচে হেফাজতকে কাছে টেনেছে আওয়ামী লীগ। কাছে টানা দোষের কিছু নয়। কিন্তু যখন হেফাজতের চাহিদা মতো পাঠ্যবইয়ে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়, কোনো সংস্কার আধুনিকায়ন না করেই মাদ্রাসা শিক্ষার ব্যাপক বিস্তার ঘটানো হয়…
২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাক ঢোল পিটিয়ে শুরু হলো দুর্নীতি বিরোধী অভিযান। বহু রথী মহারথী রাঘব বোয়াল গ্রেফতার হলো। বস্তায় বস্তায় টাকা উদ্ধারের ঘটনাও গণমাধ্যমের কল্যাণে দেখতে পেল দেশের মানুষ। ঢাক ঢোল পিটিয়ে শুরু হওয়া অভিযান থেমে গেল নীরবেই। দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের বিচার শেষ হয়নি এখন পর্যন্ত একজনেরও। এরমধ্যে অনেকেই বের হয়ে গেছেন জামিনে।
আগেই বলেছি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এদেশের মানুষ বিশ্বাস করেন আওয়ামী লীগকে। আস্থা রাখেন আওয়ামী লীগের ওপর। স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাশাও বেশি। কক্সবাজারের রামু, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর থেকে শুরু করে কুমিল্লার নানুয়া দীঘির পাড় কিংবা নড়াইল, সুনামগঞ্জের শাল্লা—আরও অনেক জায়গায় সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে।
বাড়িঘরে আগুন দেওয়া হয়েছে। ধর্মীয় উপাসনালয়ে হামলা ভাঙচুর হয়েছে। এসবের ঘটনায় অনেকেই গ্রেফতার হয়েছে। অনেককেই চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু বিচার হয়নি একটিরও। মানুষ কিন্তু পথ চেয়ে আছে। মানুষ আশায় আছে—আওয়ামী লীগ সরকার তাদের প্রতিকার দেবে।
ভোটের রাজনীতির মারপ্যাঁচে হেফাজতকে কাছে টেনেছে আওয়ামী লীগ। কাছে টানা দোষের কিছু নয়। কিন্তু যখন হেফাজতের চাহিদা মতো পাঠ্যবইয়ে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়, কোনো সংস্কার আধুনিকায়ন না করেই মাদ্রাসা শিক্ষার ব্যাপক বিস্তার ঘটানো হয়—প্রশ্ন তখনই জাগে। আওয়ামী লীগ কি তার আদর্শের সঙ্গে আপস করছে?
আওয়ামী লীগকে নিয়ে সমালোচনা আছে। সমালোচনা যৌক্তিকও। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলে—বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কোনো রাজনৈতিক দল কি আছে যাদের ওপর আস্থা রাখা যায়? বড় দল হিসেবে কেউ কেউ টিকে আছেন এখনো। কিন্তু বিগত দিনগুলোয় আন্দোলনের নামে তাদের জ্বালাও পোড়াও, নেতার মুক্তির দাবিতে আন্দোলন—ইত্যাদি নানা কিছুর মাঝে মানুষের কথা কোথায়? নিজেদের কথা যতটা বলছে তারা মানুষের কথা কি বলছে ততটা?
শুরু করেছিলাম আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কথা দিয়ে। ফিরে যাই সেখানেই। বাংলাদেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে বর্তমান সময়ে শেখ হাসিনা শুধু আওয়ামী লীগ নয়—বাংলাদেশের রাজনীতিতেই বিকল্পহীন নেতা। তিনি চাইলে সব পারেন।
তার প্রমাণ এরই মধ্যে দিয়েছেন। সুতরাং যেসব সমালোচনা কিংবা ব্যত্যয় আছে—সেগুলোর সমাধানও তিনি করবেন। অবশ্যই পারবেন—সেই আশায় আছি।
খান মুহাম্মদ রুমেল ।। অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর, সময় টিভি