
নজরুল ইসলাম
লক্ষ্মীপুর থেকে
অন্যের বাড়িতে কাজ করে জীবন চালিয়ে নেওয়া লক্ষ্মীপুরের আমেনা খাতুনের দিন কেটেছে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে, অবহেলার পাত্র হয়ে। এখন আশ্রয়ণ প্রকল্পের নতুন ঘর পেয়ে তিন সন্তানকে নিয়ে নতুনভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখছেন তিনি।
মুজিববর্ষে ভূমিহীন-গৃহহীন সব অসহায় মানুষকে নতুন ঘর উপহার দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিয়েছেন, তার আওতায় আজ নতুন করে আরও যে ২৬ হাজারের বেশি পরিবার নতুন ঘর পেয়েছেন, সে সব পরিবারেরই একজন আমেনা খাতুন।
চর কলাকোপা আশ্রয়ণ প্রকল্পে নতুন ঘরের চাবি-দলিল বুঝে পাওয়া আমেনার সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। আবেগে আপ্লুত আমেনা বলেন, বাবারে আমার নিজের কিছু নাই। অন্যদের বাড়িতে বাড়িতে জীবন পার করে দিলাম। এখন একটা ঠাঁই হলো, নিজের ঘর হলো। কী যে খুশি লাগতেছে বাবা, সেটা বুঝাতে পারব না; মনে হচ্ছে আজকে ঈদ।
যে আশ্রয়ণ প্রকল্পে নতুন ঘর পেয়েছেন আমেনা, সেই চরপোড়াগাছা ইউনিয়নে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতি এখনও জ্বলজ্বল করছে। ৫০ বছর আগে এখানে প্রথম ২১০ পরিবারকে গুচ্ছগ্রাম ধারণার প্রবর্তন করে পুনর্বাসিত করেছেন বঙ্গবন্ধু। আজ তারই কন্যা বাবার স্মৃতিবিজড়িত চরপোড়াগাছার চর কলাকোপা আশ্রয়ণ প্রকল্পে ১৪২ পরিবারকে নতুন জীবনের ঠিকানা করে দিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৃহস্পতিবার আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের তৃতীয় পর্যায়ের দ্বিতীয় ধাপের আওতায় দেশের পাঁচটি জেলার ভূমিহীন ও গৃহহীনদের মধ্যে ২৬ হাজার ২২৯টি জমিসহ ঘর হস্তান্তর করেন।
আশ্রয়ণ প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, পুরো এলাকাজুড়ে সাজ সাজ রব। সবাই নতুন জামা-কাপড় পরিধান করে আছে। জায়গায় জায়গায় খন্ড খন্ড মানুষের জটলা। অনেকে ঘুরে ঘুরে উপহারের নতুন ঘরগুলো দেখছে। আবার কেউ কেউ ছবি তুলে রাখছেন ঐতিহাসিক মুহূর্তের।
প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অনুষ্ঠানে যুক্ত হবার আগ অবদি তর সইছিল না নতুন ঘর পাওয়াদের। মরিয়ম বেগম বলেন, প্রধানমন্ত্রী জমি দিব, তারে দেখতে পামু। ঈদের চাইতেও আমার বেশি আনন্দ লাগতেছে।
প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব ড. আহমদ কায়কাউসের সঞ্চালনায় গণভবন থেকে প্রধানমন্ত্রী লক্ষ্মীপুরের রামগতির সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হবার পর বঙ্গবন্ধুকন্যার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয় নাসিমা আক্তারের। নাসিমা এর আগে উপহারের একটি ঘর উপহার পান। নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
নাসিমা বলেন, ১২ বছর আগে আমার স্বামী আমাকে রেখে চলে যায়। দুইটা মেয়ে সন্তানকে নিয়ে আমি বড় অসহায় ছিলাম। মানুষের দরজায় দরজায় ভিক্ষা করেছি। মা হয়ে সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ভিক্ষা করেছি। অন্যের ঘরে আশ্রয় নিয়ে সন্তান লালন পালন করেছি। এমন কোনো লোক ছিল না যে আমাকে একটু ছায়া দিয়ে আশ্রয় দিয়েছে। আপনি আশ্রয় দিয়েছেন। এখন সন্তান নিয়ে সুখের সংসার। ছোট্ট ঘরটিতে একটি সেলাই মেশিন চালিয়ে সন্তানদের খাওয়া, পড়া ও লেখাপড়া করাচ্ছি। আমি চাই আপনি চিরদিন বেঁচে থাকেন।
জমি হস্তান্তর অনুষ্ঠান শেষে শাহিনুর বেগম তার অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে ভাষা হারিয়ে ফেলেন। কিছু সময় চুপ থেকে এক গাল হাসি দিয়ে তিনি বলেন, আমরা নিঃস্ব। কিছুই নাই। প্রধানমন্ত্রী আমাগো ঘর দিছে। তার জন্য দোয়া করি, আল্লা তারে আরও অনেক দিন বাঁচাইয়া রাখুক।
অনুষ্ঠানে লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক মো. আনোয়ার হোছাইন আকন্দ প্রধানমন্ত্রীকে জানান, আশ্রয়ণ প্রকল্প-২-এর প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে জেলায় ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে ১ হাজার ৭৮৬টি ঘর হস্তান্তর করা হয়েছে। প্রকল্পের তৃতীয় ধাপে আরও ১ হাজার ৪৪২টি ঘর বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। চর কলাকোপা আশ্রয়ণ প্রকল্পে ১৪২ জনকে ঘর দেওয়া হয়েছে আজ। জেলায় দেওয়া হয়েছে ৪৩৬টি পরিবারকে। জেলার রামগঞ্জ ও রায়পুর উপজেলাকে ভূমিহীন ও গৃহহীনমুক্ত হলো।
আগামী দুই মাসে জেলাটিকে ভূমিহীন ও গৃহহীনমুক্ত করা হবে বলে জানান জেলা প্রশাসক।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার চর পোড়াগাছা ইউনিয়নে নদীভাঙনে ক্ষতিগস্ত ২১০টি পরিবারকে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে প্রতিটি পরিবারকে ২.৫ একর করে ভূমি বন্দোবস্ত প্রদান করে ছিন্নমূল ও অসহায় মানুষের পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু করেন। এখন বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত এই ইউনিয়নে কলাকোপা আশ্রয়ণ প্রকল্পে ৫.১৫ একর অবৈধ দখল উদ্ধারকৃত জমিতে নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত জেলে, ভিক্ষুক, বিধবা ও অসহায় ১৪২ পরিবারকে পুনর্বাসিত করা হলো।