এলএনজি-নির্ভরতা দেশকে বড় বিপদের দিকে নিয়ে যাচ্ছে?

0
5

নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে জোর দিতে হবে

নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানে বিনিয়োগ না করে গত কয়েক বছরে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি বেড়েছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যেমন কমছে, তেমনি গ্যাস খাতে ব্যয় বৃদ্ধিতে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। আমাদের জ্বালানি নিরাপত্তা হুমকিতে পড়েছে। সামনের দিনগুলোয় বড় আকারের ঝুঁকি মোকাবেলায় নিজস্ব গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানের পাশাপাশি নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে জোর দিতে হবে। 

বণিক বার্তায় প্রকাশ, ২০১৮ সালে দেশে এলএনজি আমদানি শুরুর পর থেকে গত চার অর্থবছরে গ্যাস সরবরাহে জ্বালানি বিভাগের মোট অর্থ ব্যয় হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকার কিছু বেশি। ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত ব্যয়কৃত এ অর্থের ৭৭ দশমিক ৩৮ শতাংশ খরচ হয়েছে এলএনজি আমদানিতে। দেশে গ্যাস উত্তোলনকারী বিদেশী কোম্পানিগুলোকে (আইওসি) দিতে হয়েছে ১৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ। আর স্থানীয়ভাবে গ্যাস উত্তোলনকারী তিন দেশী কোম্পানির পেছনে ব্যয় হয়েছে ৫ শতাংশের কিছু বেশি।

অন্যদিকে গত চার অর্থবছরের জাতীয় গ্রিডে দৈনিক গ্যাস সরবরাহের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ সময় দৈনিক গড় সরবরাহ হয়েছে ২ হাজার ৭০০ থেকে ২ হাজার ৯০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে আইওসির গ্যাস সরবরাহ ছিল ৫০ শতাংশ। স্থানীয় কোম্পানিগুলোর গ্যাস সরবরাহ ছিল ২৬ শতাংশ। আর আমদানীকৃত এলএনজি সরবরাহ হয়েছে গড়ে ২৪ শতাংশ। 

সরবরাহে স্বল্প অবদান রাখা এলএনজি আমদানি করতে গিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছে জ্বালানি বিভাগ। এতে আর্থিক ঝুঁকিতে পড়েছে জ্বালানি খাত। আবার দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে স্থানীয় গ্যাস উত্তোলন ও অনুসন্ধানে বিনিয়োগ ছিল যৎসামান্য। দেশে গ্যাসের সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় চলমান সংকটের পেছনে বিষয়টি অনেকাংশেই দায়ী বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এই এলএনজি-নির্ভরতা কাটিয়ে ওঠা না গেলে সামনের দিনগুলোয় বিপত্তির মাত্রা আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা তাদের। 

২০১৮ সাল থেকে দেশে এলএনজি আমদানি শুরু হয়। পেট্রোবাংলার এক হিসাব অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত জ্বালানি পণ্যটি আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৮৫ হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা, যা গ্যাস সরবরাহ বাবদ মোট ব্যয়ের ৭৭ দশমিক ৩৮ শতাংশ। স্থানীয় পর্যায়ে গ্যাসের উত্তোলনে নিয়োজিত রয়েছে বিদেশী দুটি কোম্পানি শেভরন ও তাল্লো। এ দুই কোম্পানিকে ২০২১-২২ পর্যন্ত চার অর্থবছরে গ্যাস সরবরাহের জন্য অর্থ দেয়া হয়েছে ১৯ হাজার ২০৮ কোটি টাকা, যা ব্যয়কৃত অর্থের ১৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ। এছাড়া গ্যাস উত্তোলনে স্থানীয় তিন কোম্পানি নিয়োজিত আছে—বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড (বিজিএফসিএল), সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড (এসজিএফএল) এবং বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রডাকশন কোম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স)। এ তিন কোম্পানিকে চার অর্থবছরে দেশে গ্যাস সরবরাহের জন্য পরিশোধ করা হয়েছে ৫ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা, যা এ বাবদ ব্যয়কৃত অর্থের ৫ দশমিক ২৬ শতাংশ।

আমদানিনির্ভরতা না থাকলে দেশে গ্যাস খাতে সরবরাহ বজায় রাখতে গিয়ে এত অর্থ ব্যয় করতে হতো না বলে মনে করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এলএনজিতে বেশি ঝুঁকতে গিয়ে আগের বছরগুলোয় বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে ফেলেছে জ্বালানি বিভাগ। এ নীতি থেকে বেরিয়ে আসা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। 

দেশে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হওয়া গ্যাসের প্রায় ৭৫ শতাংশই সরবরাহ হয় স্থানীয়ভাবে। বাকি ২৫ শতাংশের সংস্থান হয় এলএনজি আমদানির মাধ্যমে। এজন্য প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন পড়ছে পেট্রোবাংলার। গত পাঁচ অর্থবছরে এলএনজি আমদানি করতে গিয়ে সংস্থাটিকে ব্যয় করতে হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার কোটিরও বেশি টাকা। বর্তমানে এলএনজির আমদানি আরো বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। 

এলএনজি টার্মিনালের ক্ষেত্রে সক্ষমতার নির্দিষ্ট পরিমাণ অংশ ব্যবহার না করলেও বিদ্যুতের মতোই ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বাড়তি সক্ষমতা স্থাপনের পরও যদি উচ্চমূল্যের কারণে এলএনজি আমদানি করা না যায়, পেট্রোবাংলাকে তখন টার্মিনালগুলোর সক্ষমতা বাবদ বিপুল অংকের ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে। অর্থ সংকটের কারণে এখন বিদ্যমান টার্মিনালেই পূর্ণ সক্ষমতায় এলএনজি সরবরাহ করা যাচ্ছে না। রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের (আরপিজিসিএল) তথ্য অনুযায়ী, দেশে গত অর্থবছরে এলএনজি আমদানির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ দশমিক ৪৪ মিলিয়ন টন। চাহিদা বেশি থাকায় চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত সরবরাহ হয় ৩ দশমিক ৬৫ মিলিয়ন টনের মতো। যদিও বিদ্যমান দুটি এলএনজি টার্মিনালের বার্ষিক সরবরাহ সক্ষমতা ৭ দশমিক ২ মিলিয়ন টন।

সত্তরের দশকে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়। তখন প্রতিটি দেশই নিজস্ব জ্বালানি উৎসের অনুসন্ধানে নামে। আমরাও নিজস্ব উৎস থেকে বিদেশী বিনিয়োগে প্রডাকশন শেয়ারিং কনট্রাক্টের (পিএসসি) আওতায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে উদ্যোগ নিই। কিন্তু দেখা গেল, যে পরিমাণ তেল-গ্যাস উত্তোলন হবে তার বেশির ভাগই বিদেশী কোম্পানি পাবে। তাই তখন ভাবা হলো নিজস্ব সক্ষমতায় উত্তোলন করা হলে শতভাগ তেল-গ্যাস আমরাই পাব। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এ ভাবনা কাজে আসেনি। নিজস্ব সক্ষমতা বৃদ্ধির চেয়ে আমদানিনির্ভরতায় জোর দেয়ার একটা প্রয়াস দেখা গেছে আমলাদের একটি গ্রুপের মধ্যে। 

জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভরতা কমিয়ে উন্নত বিশ্ব এখন সৌর, বায়ু ও জলবিদ্যুতের মতো নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে ঝুঁকছে। আমাদের দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের অবারিত সুযোগ রয়েছে। সৌরবিদ্যুৎ এখন বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক। নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি ২০০৮ অনুসারে, ২০২১ সালে মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের ১০ শতাংশ হওয়ার কথা ছিল নবায়নযোগ্য। কিন্তু বাস্তবে তা ৩ শতাংশের আশপাশে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজির সঙ্গেও তা সংগতিপূর্ণ নয়। 

এছাড়া জ্বালানি তেলসহ এলএনজির জন্য বৈদেশিক বাজারের ওপর নির্ভরশীলতার ঝুঁকি দেখিয়ে দিয়েছে গত বছর শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। আমাদের নিজস্ব গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান বাড়ানোর পাশাপাশি নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে জোর দিতে হবে। তা না হলে আমরা যেমন জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারব না, তেমনি উন্নয়নশীল দেশের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা কঠিন হয়ে পড়বে। মধ্যম আয়ের কিংবা উন্নত দেশ হওয়ার স্বপ্ন কেবল স্বপ্নই থেকে যাবে।