কোসেম সুলতান হচ্ছেন উসমানিয়া বা অটোম্যান সবচেয়ে ক্ষমতাবান নারী। কোসেম সুলতান এমন এক কিংবদন্তী নারী যিনি শুধু সুলতান আহমেদের স্ত্রী হিসেবে নন, রাজ্য পরিচালনার প্রতিনিধি হিসেবেও ডাক উনার। কোসেম সুলতান উসমানীয় সাম্রাজ্যের পরিচালনা করেছিলেন লাগাতার ৩০ বছর। কোসেম সুলতান এমন এক সুলতানা যিনি ৬জন শাহজাদাকে সুলতান হতে দেখেছিলেন। তিনি ২ শাহাজাদা এবং এক নাতির সময় রাজ্য পরিচালনা করেছিলেন।
কোসেম সুলতানের সময় সাম্রাজ্যের এতটাই প্রভাব ছিলো যে, সাম্রাজ্যের সবাই সুলতানকে রেখে কোসেম সুলতানের কথাই বেশি মান্য করত। যার কারনে কোসেম সুলতানের মৃত্যুর পর এমন কিছু নিয়ম তৈরী করা হলো, যার মাধ্যেমে কোন সুলতানারা যেন আর রাজ্য পরিচালনা করতে না পারে।
কোসেম সুলতানে জন্মগত নাম ছিলো আনাস্তাসিয়া। কোসেম সুলতান ১৫৮৯ সনে জাজিরার তিউনিসিয়ায় জন্মগ্রহন করেন। যখন সুলতান আহমেদের জন্য কোসেম সুলতানকে আনা হয়, তখন উনার বয়স মাত্র ১৫ বছর ছিলো। কোসেম সুলতান যখন ইসলাম ধর্ম গ্রহন করলেন, তখন উনার নাম আনাস্তাসিয়া থেকে মাহপেকার রাখা হয়। সুলতান আহমেদের এক ঘটনাকালে উনার নাম মাহপেকার থেকে কোসেম রাখা হয়। যার অর্থ পথ প্রদর্শনকারী। কোসেম সুলতান সৌন্দর্য্য এবং বুদ্ধিমত্তার কারনে সুলতান আহমেদ হেরেমর দায়িত্বও অনেক দ্রুত উনার হাতে দিয়ে দেন।
সুলতান আহমেদ ও কোসেম সুলতানার ওরশে ৩জন শাহজাদী ও ৫জন শাহজাদার জন্ম হয়। সুলতান আহমেদের যখন মৃত্যু হয়, তখন কোসেম সুলতানের মাত্র ২৮ বছর হয়েছিল।সুলতান আহমেদের মৃত্যুর পর সাম্রাজ্যের বিভিন্ন বিশৃঙ্খলা এবং বিদ্রোহ শুরু হয়, সে সময় কোসেম সুলতান নিজেকে একজন বুদ্ধিমতি এবং প্রতিবাদী নারী হিসেবে তুলে ধরেন। যার কারনে, তিনি বিশৃঙ্খলা ও বিদ্রোহ এবং ভাই হত্যা বন্ধ করার জন্য সুলতান ওসমানকে সিংহাসনে না বসিয়ে সুলতান মুস্তফাকে সিংহাসনে বসান। সুলতান মুস্তফাকে সিংহাসনে বসানোর পরে সুলতান মুস্তফার মা হালিমা সুলতানকে পুরাতন মহল বা অশ্রুমহলে পাঠিয়ে দেন।
সুলতান মুস্তফা মানসিকভাবে পাগল থাকার কারনে সুলতান সুলতান মুস্তফাকে সরিয়ে সুলতান উসমানকে সিংহাসনে বসানো হয়। প্রায় ৬ বছর কোসেম সুলতান পুরাতন মহলে কাটিয়ে থাকেন।
১৬২৩ সনে যখন সুলতান উসমানকে বিদ্রোহকারীরা হত্যা করে, এরপরে কোসেম সুলতানকে তোপকাপি প্রসাদে আনা হয়।
সুলতান উসমানের মৃত্যুর পরে বড় শাহজাদা হিসেবে কোসেম সুলতানের বড় ছেলে শাহজাদ মুরাদ সিংহাসনে বসেন যখন শাহজাদা মুরাদ সিংহাসনে বসেন, তখন উনার বয়স অনেক কম ছিল। যার ফলে তিনি মুরাদের প্রতিনিধি হিসেবে ১০ বছর রাজ্য পরিচালনা করেন। এই ১০ বছরে কোসেম সুলতানকে অনেক ধরনের বিদ্রোহ ও ষড়যন্ত্রের সম্মুখীন হতে হয়। তিনি তার বুদ্ধি দিয়ে বিদ্রোহ ও ষড়যন্ত্র দমন করতে সক্ষম হন।
১৬৩২ সনে যখন সুলতান মুরাদ সিংহাসনে উপযুক্ত হন তখন কোসেম সুলতানকে রাজ্যেও প্রতিনিধির কাছ থেকে সরিয়ে দেন। ১৬৩৫সনে একটি ভুলের কারনে ,সুলতান মুরাদ কোসেম সুলতানের ছেলে শাহজাদা ইব্রাহিমকে মৃত্যুদন্ড আদেশ ঘোষনা করলে কোসেম সুলতান শাহজাদাকে এই আদেশ হতে রক্ষা করে ফেলেন । এর মাধ্যমে ১৬৪০ সালে যখন সুলতান মুরাদেও কোন শাহজাদা ছিলোনা। যার কারনে ,শাহজাদা ইব্রাহিম হয় উসমানিয়া সাম্রাজ্যের সুলতান।
সুলতান ইব্রাহিমকে ও রাজ্যে পরিচালনার আগ্রহ না থাকায় আবার ৮ বছর রাজ্যের প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত হন কোসেম সুলতান। এবং তখনকার সময় ও কোসেম সুলতানের বিশ্বস্ত সেবক উজিরে আজম মুস্তফা পাশা ও রাজ্যে পরিচালনা করতে কোসেম সুলতানকে অনেক সাহায্য করেছিলেন। সুলতান ইব্রাহিমের প্রিয় খাসবাদী হেতীজে তুরহান সুলতানের কথা শুনে কোসেম সুলতানকে আবার পুরাতন মহলে পাঠিয়ে দেন
আনুমাানিক ৮ই আষ্ট ১৬৪৮সালে সুলতান ই্ররাহিমকে বিদ্রোহিদের হাতে কারাবন্দী হতে হয় ,সুলতান ইব্রাহমিকে কারাবন্দী সুলতান ইব্রাহিমের সাত বছরের ছেলেকে সিংহাসনে বসানো হয়। তুরহান সুলতান তখন হয়ে যান বেগম সুলতানা। তুরহান সুলতানের রাজ্য পরিচালনা তেমন কোন অভিজ্ঞতা না থাকায় আবার কোসেম সুলতান রাজ্যের প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৮ ই আগষ্ট ১৬৪৮ সালে সুলতান ইব্রাহিমকে ও ফাঁসি দেওয়া হয়।
কোসেম সুলতানের প্রভাব এতটাই বিস্তৃ ছিলো যে উনার সাথে রাজ্যেও মানুষের সাথে ,সৈন্যদের সাথে এবং আলেম সমাজের মধ্যে অনেক সম্মান করা হতো। হেতিজা তুরহান সুলতান কোসেমনের বিরুদ্ধে দাড়িয়ে যান। এবং কোসেম সুলতানের ক্ষমতাকে একেবারে শেষ করে দিতে চেয়েছিলেন। কারন ,হেতিজা তুরহান সুলতান কোসেম সুলতানকে সুলতান ইব্রাহিমের মৃত্যুর জন্য দায়ী মেনে নিয়েছিলেন। এই কারনে ,তুরহান সুলতান কোসেম সুলতানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করেন।
এদিকে কোসেম সুলতান ,সৈন্যদের নিয়ে সুলতান মোহাম্মদকে সিংহাসনচ্যুত করে তার ভাই সুলতান সুলেমানকে সিংহাসনে বসাতে চেয়েছিলেন। তুরহান সুলতান এই ব্যাপারে অবগত হয়ে যান,যার কারনে ১০ সেপ্টেম্বর ১৬৫১ সনে কোসেম সুলতানকে ফাঁসির মাধ্যমে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। কোসেম সুলতানকে সুলতান আহমদের কবরের পাশে দাফন করা হয়। কোসেম সুলতানের মৃত্যুর কারনে রাজ্যের মানুষ এতটাই শোকাহত হয়েছে যে ইস্তাম্বুলে ৩ দিনের জন্য বাজার বন্ধ রাখা হয়েছিলো।
কোসেম সুলতান অনেক দানশীল ছিলো বলে জানা যায়। তিনি একটি মসজিদ তৈরী করেছিলেন,এবং মিশরের সাহায্যের জন্য তিনি রাষ্ট্রীয় কোষাগার খুলে দিয়েছিলেন। আর গরীব দুঃখীদের উনি সাহায্য করতেন বলে জানা যায়। উনাকে বিভিন্ন উপাধি দিযে ডাকা হয়ে থাকে, যেমন, সেরা বেগম সুলতানা। হাসেকী বেগম সুলতানা ইত্যাদি।