
মোঃ আলফাত হোসেন সাতক্ষীরা জেলা প্রতিনিধিঃ
সুন্দরবন নামের ব্যাখ্যা নিয়ে নানান মত রয়েছে, মত যাই থাক সুন্দরবনের আকর্ষনের বিষয় হলো এর উদ্ভিদ,উদ্ভিজ্জ সুন্দরবনের গাছপালার অধিকাংশই ম্যানগ্রোভ ধরনের এবং এখানে রয়েছে বৃক্ষ, লতাগুল্ম, ঘাস, পরগাছা এবং আরোহী উদ্ভিদসহ নানা ধরনের উদ্ভিদ।
পৃথিবীর অন্য অঞ্চলের গাছপালা থেকে এই অঞ্চলের গাছপালার বিশেষত্ব হল, এখানকার প্রায় সব গাছই লবণ সহ্য করতে পারে। দ্বিতীয় বিশেষত্ব হল, এই গাছগুলো নরম কাদার ওপর জন্মায়,তৃতীয়ত, এই সকল গাছ প্রবল বাতাস এবং প্রচণ্ড স্রোতে অসংখ্য শিকড়ের সাহায্যে এই নরম মাটির ওপর সহজেই দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। জোয়ারের পানিতে গাছের গোঁড়া সবসময় ধুয়ে গেলেও গাছের কোনো ক্ষতি হয়না। বাতাস থেকে অক্সিজেন ও জলীয় বাষ্প নেওয়ার জন্য এই গাছেদের শূলের মতো সূচালো শ্বাসমূল থাকে, ১৯০৩ সালে ডি. প্রেইন সুন্দরবনের গাছপালার উপর লিখিত বইয়ে ২৪৫ গণের অধীনে ৩৩৪টি উদ্ভিদ প্রজাতি লিপিবদ্ধ করেছেন,আজ পর্যন্ত জানা প্রায় ৫০টি প্রকৃত ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ প্রজাতির মধ্যে কেবল সুন্দরবনেই আছে ৩৫টি প্রজাতি। অধিকাংশ ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ চিরসবুজ, খাটো, গুল্মজাতীয় অথবা লম্বা বৃক্ষজাতীয়,এদের অনেকেই বনের তলদেশ খালি না রেখে সাধারণত দলবদ্ধভাবে জন্মায়।
সুন্দরবনের কিছু গাছের পরিচয় তুলে ধরলাম,গেওয়া (Excoecaria agallocha) গেওয়া সোজা লম্ব হয়ে উঠে যায়। এর দেহ থেকে সাদা কষ বের হয়,এই কষ খুবই বিষাক্ত এবং আঠালো,এই গাছের কাঠ হালকা, তাই এই গাছের বড় বড় গুড়ি দিয়ে ঢোল এবং তবলা তৈরি হয়। সাধারণত এই গাছ জোয়ারে প্লাবিত ভূমিতেই বেশি দেখা যায়। এর পাতা ও ফল হরিণের প্রিয় খাবার।
গরান (Ceriops decandra)গরান গাছ প্রায় ৩-৪ মিটার উঁচু হয়,এই গাছগুলো ঝাড়বিশিষ্ট,এক ঝাড়ে অনেক কয়টি গাছ থাকে,কাঠ অতি শক্ত, গাছের ভেতরের রঙ লাল,গরানের বন বাঘের প্রিয় আবাসস্থল।কারণ ঝাড়ের ভেতর আত্মগোপনের সুবিধা। এটা সুন্দরবনের দক্ষিনাঞ্চলে জন্মে।
কেওড়া (Sonneratia apetala) সুন্দরবনের অন্যসব গাছের মতো কেওড়া গাছ মানুষের কাজে খুব একটা না লাগলেও সুন্দরবনের বানর এবং হরিণ অনেকাংশে এই গাছের ওপর নির্ভরশীল। নদী ও খালের কাছেই এই গাছ জন্মায়, এর ফলের স্বাদ টক। কেওড়া ফলের চাটনি বা টক মুখরোচক। কেওড়া বা ওড়া একই প্রজাতির গাছ।
ছইলা বা ওড়া (Sonneratia caseolaris) এরও টক রান্না করে খায়।
পশুর (Xylocarpus mekongensis) বাইনের মতো পশুর গাছও বড় গাছ। পশুরের পাতা অনেকটা কাঁঠাল পাতার মতো। এই গাছ নদীর ধার ঘেষে জন্মায়।
ধুন্দুল (Xylocarpus granatum) পশুর বা ধুন্দুল একই প্রজাতির গাছ। তবে পশুর থেকে এর ফলের আঁকার বেশ বড় হয়। এই গাছ বনের ভেতরে শক্ত মাটিতে জন্মায়।
৩ ধরণের বাইন (Avicennia alba, A. marina, A officinales) নতুন পলি জমে যে ভূখণ্ড জেগে ওঠে তাতে বাইনের বন বেশি গড়ে উঠতে দেখা যায়। বাইন বেশ বড় গাছ, এর আয়ুও বেশ দীর্ঘ। এই গাছে ভালো কাঠ হয়। ৩ প্রজাতির বাইন দেখা যায় সুন্দরবনে। ১টি দেখতে কেওড়ার মত, নদীর খানিকটা উঁচুতে এটা জন্মে।
হেঁতাল বা হেন্দাল (Phoenix pelludosa) হেঁতাল গাছ লবণাক্ত জমিতে কম জন্মায়। এই গাছ জন্মায় উঁচু জমিতে, দেখতে অনেকটা খেজুর গাছের মতো। এক জায়গায় অনেক হেঁতাল ঝাড় দেখা যায়। হেঁতাল দৈর্ঘ্যে ৫-৬ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। হেঁতালের গাছের আশে পাশে বাইন গাছও দেখা যায়। এই গাছ সুন্দরবনের সর্বত্রই দেখা যায়। এর ফুল থেকে মৌমাছিরা মধু সংগ্রহ করে।
সুন্দরী ( Heritiera fomes)সুন্দরবনের গাছগুলোর মধ্যে সবথেকে আকর্ষণীয় হল সুন্দরী গাছ,সুন্দরীর পাতা ছোট, লবঙ্গের পাতার আকারবিশিষ্ট,এর পাতার পৃষ্ঠভাগ মসৃণ, এর নিচের অংশ ধূসর,সুন্দরীর ফুলও আকারে ছোট,বর্ণ হলুদ,সুন্দরী গাছ লম্বায় ১০-২৫ মিটার পর্যন্ত হতে পারে, সম্পূর্ণ বড় হয়ে গেলে কিছুটা বড়সড় জাম গাছের মতো দেখায়,সুন্দরীর গুড়ির বেড় ২০-২৫ সেন্টিমিটারের মতো হয়ে থাকে,কাঠ গাঢ় লাল এবং শক্ত। এর কাঠ খুবই মূল্যবান,বলেশ্বর ও শিবসা নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে সুন্দরী গাছের সমারোহ।
নিপা পাম বা গোলপাতা (Nipa fruticans): সুন্দরবনের অন্যতম খ্যাতিমান গাছ হল গোলপাতা। নারকেলজাতীয় এই গাছটি মাটির ওপরে মুলাকৃতির কাণ্ড থেকে নারিকেল বা তাল পাতার মতো সরাসরি বেরিয়ে আসে। শাখাহীন এই গাছের ফল আকারে প্রায় ফুটবলের মতো বড়, এই ফলের কারণেই এই গাছের নাম গোল হয়েছে। এর ফল খেতে বেশ সুস্বাদু, কিছুটা তালের শ্বাসের মতো। এই গাছের পাতা দিয়ে ঘর ছাওয়া যায়। সুন্দরবন থেকে প্রতিদিনই প্রচুর পরিমানে এই গাছ নিধন করা হয় যে কারণে এই গাছ হুমকির মুখে রয়েছে। এই গাছ জন্মে নদীর খাঁড়ি ও তীরভূমিতে।
টাইগার ফার্ন (Acrosticum aureum)গা-ঢাকা দেওয়ার জন্য বাঘ এসব ঝোপ ব্যবহার করে।
গর্জন বা ঝানা (Rhizophora mucronata) সুন্দরবনের প্রায়ই সবখানে গর্জন গাছের দেখা পাওয়া যায়, এই গাছের পাতা রবার গাছের পাতার মতো পুরু।
ফুল ছোট, আর ফল হয় বকফুল কিংবা সজনের ফলের মতো লম্বাটে, কাঠ লালচে ধূসর বর্ণের, কাঠ খুব টেকসই নয়। এর ফল দেখতে ছাগলের শিং এর মত।
কাঁকড়া (Bruguiera gymnorrhiza) কাঁকড়া গাছের পাতাও কিছুটা গর্জন পাতার মতো দেখতে হয়। তবে এ গাছের ফুলের বৃন্ত লাল কাঁকড়ার পায়ের মতো দেখায় বলে একে কাঁকড়া গাছ বলা হয়ে থাকে। এর কাঠ মজবুত এবং শক্তিশালী হওয়ার কারণে ঘরের ছাদের বীম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই গাছ অনেক উঁচু হয়।
পরশপিপুল(Thespesia populnea SynSyn.Hibiscus populnea) কেওড়ার মতো নদীর ধারে পরশ গাছও জন্মায়,নদীর ধারে পরশ গাছের ঝাড় দেখা যায়,হরগোজা (Acanthus ilicifolius) এই গাছে কাঁটা ভর্তি থাকে,ফুল বেগুনি রঙের।
কুম্ব (Barringtonia racemosa) সুন্দরী লতা ( Brownlowia tersa) ডাগর ( Cerbera manghas) গুরা বা গুরাল (Kandelia candel) নোনা ঝাউ (Tamarix indica) নোনা ঝাউ (Tamarix indica) পুইন্যাল( Calophyllum inophyllum) সিংড়া (Cynometra ramiflora) কালি লতা (Derristrifoliata )আরালি (Leersia hexandra) খুলশী (Aegiceras corniculatum) তুনশা (Bruguiera cylindrica)করঞ্চা (Pongamia pinnata)সুন্দরবনের উৎপত্তি সম্পর্কে খুব বেশি ইতিহাস পাওয়া যায় না,তবে ধারণা করা হয়, হিমালয়ের ভূমিক্ষয় জনিত পলি বালু নুড়ি হাজার বছর ধরে বয়ে চলা পদ্মা ও ব্রহ্মপুত্র কর্তৃক উপকূলে চরের সৃষ্টি করেছে,অন্যদিকে সমুদ্র তীরবর্তী হওয়ায় লবণাক্ত জলের ধারায় সিক্ত হয়েছে এ চর এবং জমা হয়েছে পলি কালাতিক্রমে সেখানে জন্ম নিয়েছে বিচিত্রজাতের উদ্ভিদ এবং গড়ে উঠেছে ম্যানগ্রোব জাতের উদ্ভিদ এবং গড়ে উঠেছে ম্যানগ্রোব ফরেস্ট বা লবণাক্ত পানির বন। সম্ভবত ১২০৩ সালে মোগল এক রাজা পুরো সুন্দরবন ইজারা নেন,১৭৫৭ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সুন্দরবনসহ পুরো বাংলার দায়িত্ব নেয়ার আগে মোগল রাজাদের অধীনে ছিল এই বন,এই কোম্পানি সুন্দরবনের মানচিত্র তৈরি করে। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সময় সুন্দরবনের ৬ হাজার ১৭ কিলোমিটার বাংলাদেশের অংশে পড়ে, যা বাংলাদেশের সমগ্র বনভূমির ৪৪ শতাংশ,১৯৯৬ সালে সুন্দরবনে তিনটি অভয়ারণ্য ও ২০১২ সালে তিনটি ডলফিন অভয়ারণ্য প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৯৭ সালে সুন্দরবনের এক লাখ ৩৯ হাজার ৭০০ হেক্টর বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য এলাকাকে ৯৮তম বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষণা করে ইউনেসকো। পৃথিবীর অন্যান্য ম্যানগ্রোভ বনভূমির উদ্ভিদের তুলনায় সুন্দরবনের উদ্ভিদের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য দেখা যায়। কেননা, সুন্দরবনের বুক চিরে লোনা পানি বয়,ক্ষেত্র বিশেষে প্রবাহিত হয় স্বাদু পানির ধারা,এই বৈশিষ্ট্যই সুন্দরবনকে পৃথক করেছে বিশ্বব্যাপী অন্যান্য ম্যানগ্রোভ বন থেকে,এ বনের পূর্বাঞ্চলীয় অভয়ারণ্যে বেশি দেখা দেয়।
এখানে জন্মে সুন্দরী, গেওয়া, পশুর, কেওড়া আমুর গোলপাতা,পশ্চিমাঞ্চলীয় অভয়ারণ্যে বেশি দেখা দেয় গেওয়া, গরান, হেতাল।
দক্ষিণাঞ্চলীয় অভয়ারণ্যে বেশি দেখা দেয় গেওয়া গাছ। এই অঞ্চলে লবনাক্ততা বেশী হওয়ায় অন্যান্য সাধারণ গাছ বেশি জন্মাতে দেখা যায় না। সুন্দরবনে কত প্রজাতির গাছ আছে তা বলা মুশকিল। সর্বশেষ ১৯০৩ সালে জরিপ বলছে, ৩৩৪ প্রজাতি,ম্যানগ্রোভ বনের ৫০ প্রজাতির উদ্ভিদের মধ্য ৩৫টির দেখা মেলে এই বনে।
প্রাণী বৈচিত্র্যের কথা লিখতে গেলে প্রথমে আসে অনিন্দ সুন্দর বেঙ্গল টাইগারের কথা,সুন্দরবনসহ গোটা বাংলাদেশের অহংকার এই পশু,একটা সময় সুন্দরবন জুড়ে অসংখ্য বিচরণ চোখে পড়ত এই বাঘের। কিন্তু অবৈধ শিকার,খাদ্যের অভাব, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ বিভিন্ন কারণে সুন্দরবন দিনে দিনে বাঘের সংখ্যা কমে গিয়েছিলো তবে এখন বাঘের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে বলে দাবী বনবিভাগের।
বাঘ ছাড়াও আছে প্রায় ৩১ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী। যার মধ্যে চিত্রা হরিণ মায়া হরিণ রেসাস বানর, বন বিড়াল, লেপার্ড, বন্য শূকর উল্লেখযোগ্য।