Logo
মঙ্গলবার , ৩১ অক্টোবর ২০২৩ | ২০শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
  1. অপরাধ
  2. অর্থনীতি
  3. আইন আদালত
  4. আঞ্চলিক খবর
  5. আন্তর্জাতিক
  6. আবহাওয়া
  7. ইতিহাস ও ঐতিহ্য
  8. উন্নয়ণ
  9. করোনা
  10. কৃষিবার্তা
  11. ক্যাম্পাস বার্তা
  12. খেলাধুলা
  13. খোলা কলাম
  14. গণমাধ্যম
  15. গল্প ও কবিতা

টেকসই শহর নির্মাণে কার্যকর বিনিয়োগ দেখা যাচ্ছে না

প্রতিবেদক
admin
অক্টোবর ৩১, ২০২৩ ৯:১০ পূর্বাহ্ণ

ড. মো. ইকবাল সরোয়ার

আজ বিশ্ব শহর দিবস। জাতিসংঘের জেনারেল অ্যাসেম্বলি কর্তৃক ২০১৪ সালের ৩১ অক্টোবর থেকে বিশ্ব সিটি দিবস পালন হয়ে আসছে। জাতিসংঘ কর্তৃক ২০২৩ সালের বিশ্ব শহর দিবসের থিম হচ্ছে ‘Financing Sustainable Urban Future for All’। নানা কারণে মানুষ এখন শহরমুখী, ক্রমাগত এ শহরমুখী মানুষের জন্য পৃথিবীব্যাপী শহরগুলোয় বিভিন্ন ধরনের চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। শহরের ওপর ক্রমাগত বিভিন্ন ধরনের চাপের কারণে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বাস উপযোগী টেকসই নগর পরিবেশ ও পর্যাপ্ত বিনিয়োগ এখন সময়ের দাবি। শহরে জনসংখ্যা সাধারণত বৃদ্ধি পায় স্বাভাবিক জন্মগ্রহণ এবং অভিগমনের মাধ্যমে। বর্তমান যে গতিতে শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে সে গতিতে সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা সম্ভব হচ্ছে না, যা ভবিষ্যৎ টেকসই নগর পরিবেশের জন্য বিশাল হুমকি। বাংলাদেশের মতো বিশ্বের অন্যান্য দেশের শহরগুলোতেও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য উন্নত জীবন এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। শহরের জনসংখ্যার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের টেকসই নগরজীবনের জন্য মূলত যে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতে হবে তা হলো আবাসন, যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নগরীয় দূষণ রোধ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা।

International Migration Organization (IMO)-এর হিসাবে এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে প্রতিদিন আনুমানিক ১ লাখ ২০ হাজার মানুষ গ্রাম থেকে শহরে আসছে। আর সারা বিশ্বে বিভিন্ন কারণে প্রতি সপ্তাহে ৩০ লাখ মানুষ শহরে অভিগমন করছে। এ অভিগমনের কিছু কারণ হলো শহর এলাকার আকর্ষণ (Pull) জনিত, যেমন চাকরি, উন্নত জীবন, চিকিৎসা, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি। অন্যদিকে রয়েছে কিছু বিকর্ষণ (Push) জনিত অসুবিধা, যেমন দুর্যোগ, বেকার জীবন, পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাব। ফলে শহরে তৈরি হচ্ছে নানা চাপ ও চ্যালেঞ্জ। World Migration Report 2016–অনুযায়ী, এ অঞ্চলে ২০৫০ সালের মধ্যে শহরে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা দাঁড়াবে ৬৩ শতাংশে। আর ২০৫০ সালে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা দাঁড়াবে ২০ কোটি, এর মধ্যে শহরের জনসংখ্যা হবে প্রায় ১৩ কোটি। অন্যদিকে বিবিএস-২০১১ শুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশের ১৫-২৯ বছর বয়সী জনসংখ্যা ৪ কোটি ১২ লাখ। এ তরুণ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ২০২৬ সালে দাঁড়াবে ৫ কোটি ৮ লাখ। জাতিসংঘের Economic and social Affairs-এর Population Division কর্তৃক প্রকাশিত World Urbanization Prospects -এর হিসাবে সমগ্র পৃথিবীতে ৫৫ ভাগ (৪ দশমিক ২ বিলিয়ন) মানুষ শহরে বসবাস করে। নগর বা শহরের জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের প্রথম ১০টি শহরের মধ্যে ঢাকা শহরের অবস্থান নবম। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী বর্তমান ৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ হারে শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকলে ২০৩০ সালে জনসংখ্যার দিক থেকে ভারতের দিল্লি হবে বিশ্বের বৃহত্তম শহর এবং বাংলাদেশের ঢাকা হবে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম শহর (জনসংখ্যা হবে ২ কোটি ৮ লাখ)। বর্তমানে ঢাকা শহর বিশ্বের ২৯টি মেগাসিটির একটি এবং দক্ষিণ এশিয়ার ছয়টির মধ্যে একটি। বসবাস উপযুক্ততার সূচকে ঢাকার অবস্থান ১৪০ দেশের মধ্যে ১৩৯তম। বর্তমানে সমগ্র দেশে প্রায় ৩৫ শতাংশ মানুষ নগরে বাস করে, ২০৫০-এর দিকে নগর জনসংখ্যা হবে ১৩ কোটি। সুতরাং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা চিন্তা করে নতুন প্রকল্প প্রণয়ন করতে হবে, শহর এলাকায় পর্যাপ্ত বিনিয়োগে এগিয়ে আসতে হবে এবং সমন্বয়ের মাধ্যমে প্রকল্পগুলো পরিচালিত করতে হবে। এ বিশাল নগর জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশের নগরগুলো সমান্তরালভাবে ঢেলে সাজাতে হবে; এজন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ।

সুতরাং ক্রমবর্ধমান এ শহরে জনসংখ্যার উন্নত জীবন ব্যবস্থা ও সুযোগ-সুবিধা কীভাবে নিশ্চিত করা যাবে তার পরিকল্পনা এখনই গ্রহণ করতে হবে। গ্রাম থেকে শহরে অভিগমন কমিয়ে নগর জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমাতে হবে। অভিগমন হলেও বড় শহরগুলোয় যেন এর মাত্রা কম হয় সে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ঢাকা-চট্টগ্রামের মতো শহরগুলোয় নতুন করে শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান স্থাপন নিরুৎসাহিত করতে হবে। নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান দেশের অন্যান্য অঞ্চলে স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে এবং সেখানে শিল্প স্থাপনে উপযুক্ত পরিবেশ ও বিনিয়োগে আকর্ষণ সৃষ্টি করতে হবে। পাবলিক/প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজগুলো দু-একটি শহরকেন্দ্রিক না করে দেশের অন্যান্য শহরে ছড়িয়ে দিতে হবে এবং মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। অনেক সময় দেখা যায়, গ্রাম বা অন্যান্য ছোট শহর থেকে ঢাকা বা চট্টগ্রামের মতো শহরে পড়ালেখা করতে এসে একসময় তার পুরো পরিবারও অভিগমন করে শহরে চলে আসে। এসব দিক বিবেচনা করে শিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যবসা-বাণিজ্য বিকেন্দ্রীকরণ করে দিলে শহরে অভিগমন হার কমে আসবে, শহরের ওপর চাপও কমবে। একই সঙ্গে শহর এলাকার বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা পরিকল্পিতভাবে বৃদ্ধি করতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উন্নত জীবনের জন্য শহর এলাকার জনসংখ্যার ঘনত্ব কমাতে হবে এবং আবাসন ব্যবস্থার সঠিক পরিকল্পনা করতে হবে। বিশ্বব্যাংকের মতে, ঢাকা শহরে ২০৫০ সাল নাগাদ আবাসন সংকট নিরসনে ২০ কোটি ইউনিট বাড়ি নির্মাণ প্রয়োজন হবে। এজন্য পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষা করে আবাসিক শিল্প ও বাণিজ্যের জন্য জমি ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে করতে হবে। এ পরিকল্পনা উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও বস্তিবাসীর জন্য পৃথক হতে হবে। এছাড়া শিক্ষা, সুপেয় পানি, স্বাস্থ্যসেবা ও জ্বালানির যথাযথ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। যেমন ঢাকা শহরে দৈনিক ২০৫ কোটি লিটার পানির চাহিদার বিপরীতে ঢাকা ওয়াসার সরবরাহ ১৬৫ কোটি লিটার। অন্যদিকে চট্টগ্রাম শহরে বর্তমানে ওয়াসার পানির চাহিদা দৈনিক ৫০ কোটি লিটার কিন্তু সরবরাহ ৪৫ কোটি লিটার (চাহিদার ৮৪ শতাংশ)। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০৩০ সাল নাগাদ চট্টগ্রাম শহরে সুপেয় পানির চাহিদা দাঁড়াবে ৫৮ কোটি লিটার। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উন্নততর জীবনের জন্য পর্যাপ্ত সুপেয় পানির ব্যবস্থা করাও এক চ্যালেঞ্জ। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য সরকারি-বেসরকারি উভয় পর্যায়েই আধুনিক দক্ষ চিকিৎসকের পাশাপাশি হাসপাতালে সেবা দেয়ার পরিধি ও হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, সারা দেশে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা দানকারী হাসপাতালের সংখ্যা ২ হাজার ২৩৫টি। এর মধ্যে ঢাকা শহরে নিবন্ধন আছে এমন হাসপাতাল, ক্লিনিক ও রোগনির্ণয় সেন্টার আছে ১ হাজার ২০০টি। অন্যদিকে প্রয়োজনীয় জনবল ও চিকিৎসকের অভাবে বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের স্বাস্থ্যসেবার অবস্থা আরো খারাপ, এখানে সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা দানকারী হাসপাতালের সংখ্যা প্রায় ১০০টি। চট্টগ্রাম মেডিকেল সরকারি হাসপাতালে বর্তমানে শয্যা সংখ্যা ১ হাজার ৩১৩টি এবং চট্টগ্রামের জেনারেল হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা ২৫০টি, যা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রয়োজনীয় জনবল ও চিকিৎসক না থাকা সত্ত্বেও দৈনিক ছয়-সাত হাজার রোগীকে সেবা দিতে হয়। মূলত অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং জনঘনত্বের জন্য শহর এলাকার পরিবেশ ও অন্যান্য সেবা সংস্থার এ করুণ অবস্থা। সামগ্রিকভাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উন্নত জীবনের কথা চিন্তা করে পর্যাপ্ত হাঁটার রাস্তা অথবা সাইকেলের ব্যাপক প্রচলন বৃদ্ধি করা যেতে পারে। এছাড়া যানবাহনের সংখ্যা, সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়ন, গণপরিবহন ব্যবস্থার সংস্কার ইত্যাদি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত জরুরি। জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রভাব যাতে নগর পরিবেশের ওপর না পড়ে সেজন্য পরিকল্পিত ভূমি ব্যবহার এবং পুকুর জলাশয় সংরক্ষণ করতে হবে। বর্ধিত নগর জনসংখ্যার জন্য টেকসই জীবন ব্যবস্থা ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নগরবাসীর জন্য আরো প্রয়োজন—১. খেলাধুলার জন্য পর্যাপ্ত মাঠ ও উন্মুক্ত জায়গা তৈরিতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ, ২. শহরের যুগোপযোগী ও মানসম্পন্ন শিক্ষায় মনোযোগ, ৩. মানসম্পন্ন স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতকরণ, ৪. কভিড-১৯, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার মতো নিত্যনতুন রোগ ও দুর্ভোগ মোকাবেলার প্রযুক্তি, লোকবল ও ওষুধ সামগ্রীতে বিনিয়োগ, ৫. নগর দারিদ্র্য হ্রাস করে কর্মক্ষম নগর জনগোষ্ঠী গড়তে যথাযথ পরিকল্পনা ও অর্থসংস্থান, ৬. নগর দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য উন্নত প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ এবং সচেতনতা বৃদ্ধি, ৭. পুষ্টিকর ভেজালমুক্ত ও স্বাস্থ্যসম্মত খাবার নিশ্চিতকরণ, ৮. পরিকল্পিত নগরায়ণে সবার মতৈক্য প্রতিষ্ঠা, ৯. সব ধরনের দূষণ রোধ করে সুষ্ঠুভাবে যানবাহন চলাচল ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আধুনিক প্রযুক্তির প্রচলন এবং ১০. পরিবেশসম্মত ও মানবিক শহর গড়তে সবাইকে সচেষ্ট হওয়া।

ড. মো. ইকবাল সরোয়ার: অধ্যাপক, ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

সর্বশেষ - অপরাধ