দেশে এক বছরে ১০ লাখ ৬০ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য

ওয়ানটাইম প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ হোক

বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল ও জনবহুল দেশ। পরিবেশের ভারসাম্য ঠিক রেখে টেকসই উন্নয়ন দেশের প্রধান লক্ষ্য। এ উন্নয়ন করতে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা প্রতিনিয়ত বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে; প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এর মধ্যে অন্যতম। কারণ প্লাস্টিক অপচনশীল অবস্থায় দীর্ঘদিন পরিবেশে থেকে যায়। দেশে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১০ লাখ ৬০ হাজার টন একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন হয়েছে, যার মধ্যে ১ লাখ ৯২ হাজার ১০৪ টনই বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীর মিনিপ্যাক বলে গবেষণা সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) ‘প্লাস্টিক স্যাশে: স্মল প্যাকেট উইথ হিউজ এনভায়রনমেন্ট ডেস্ট্রাকশন’ শীর্ষক এক গবেষণায় উঠে এসেছে। এসডোর গবেষণা অনুযায়ী, কেবল খাবারের (চিপস, টমেটো সস, জুস, গুঁড়ো দুধ, কফি ইত্যাদি) মিনিপ্যাকেই ৪০ শতাংশ ক্ষুদ্র প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন হয়েছে। ক্ষুদ্র প্লাস্টিক বর্জ্য ক্রমে দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ প্লাস্টিক অপচনশীল অবস্থায় দীর্ঘদিন পরিবেশে থেকে যায়। শহরে জলাবদ্ধতা থেকে শুরু করে নদীদূষণেও প্লাস্টিক বড় ভূমিকা রাখছে। এমন প্রেক্ষাপটে টেকসই প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা প্রণয়ন জরুরি। থ্রি আর (রিডিউস, রি-ইউজ ও রিসাইকেল) পলিসি কার্যকর করে প্লাস্টিক বর্জ্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়া কঠিন নয়। এক্ষেত্রে পরিকল্পনার কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।

বাংলাদেশ সরকার প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। কিন্তু ফল আশাব্যঞ্জক নয়। প্লাস্টিক রিসাইকেল ব্যবস্থা এক ধরনের অর্থনীতি এবং এ অর্থনীতির মূলে রয়েছে কার্যকর সংগ্রহ ব্যবস্থা। পশ্চিম ইউরোপের অনেক দেশ, যেমন জার্মানি কার্যকরভাবেই এ ব্যবস্থা চালু করে প্লাস্টিক বর্জ্যকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত রিসাইকেল ব্যবস্থায় এনেছে। পাশাপাশি বোতল জমা দেয়ার ব্যবস্থা, রিসাইকেল মেশিন ও প্লান্ট সহজলভ্য করেছে। একবার এ প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনা ও রিসাইকেলের অর্থনীতি চালু করতে পারলে বেসরকারি খাতও এর সঙ্গে যুক্ত হবে। আবার ভারতের মেঘালয়ের মতো রিসাইকেল করা প্লাস্টিক দিয়ে রাস্তার পিচ ঢালাই বা অন্যান্য অর্থনৈতিক কাজের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা যায়। শুধু বাংলাদেশ নয়, করোনা মহামারীতে বিশ্বের প্রতিটি দেশেই ওয়ানটাইম ও মিনিপ্যাক প্লাস্টিকের ব্যবহার বেড়েছে। চীন, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ সর্বত্র এটি বেড়ে ওঠার তথ্য মিলছে। ওই দেশে সরকারি সংস্থাগুলোর পাশাপাশি বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানও এসব বর্জ্যের ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। খোদ প্লাস্টিক উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলোও প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবস্থাপনায় তাদের প্রচেষ্টা বাড়িয়েছে, যাতে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ক্ষতি প্রশমন করা যায়। দেশগুলোয় আগে থেকে প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনা নীতি বিদ্যমান। সেখানে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এখতিয়ার ও দায়িত্ব সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত। তার পরও বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে প্রত্যেকেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্লাস্টিক উপকরণের সঠিক ব্যবস্থাপনায় কাজ করছে, দায়িত্বশীল আচরণ করছে। এসব দেশের অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য শিক্ষণীয় বৈকি।

দূষণের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য স্ট্র থেকে শুরু করে সিগারেটের প্যাকেট পর্যন্ত একক ব্যবহারযোগ্য ১৯ ধরনের প্লাস্টিক পণ্যের ওপর চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ভারত। দেশটির সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে, সারা দেশে এখন থেকে একবার ব্যবহার করা যাবে—এমন প্লাস্টিক আর ব্যবহার করা যাবে না। এর পরিবর্তে বিকল্প উপায় অবলম্বন করতে হবে। এ নিষেধাজ্ঞার আওতায় রয়েছে একক ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি ১৯ ধরনের সামগ্রী। ক্যারি ব্যাগের পাশাপাশি নিষেধাজ্ঞার তালিকায় রয়েছে প্লাস্টিকের চামচ, কাঁটা-চামচ, প্লাস্টিকের কাপ, প্লাস্টিকের পতাকা, প্লাস্টিকের ইয়ার-বাডস, প্লাস্টিকের ছুরি, ট্রে প্রভৃতি। আর এ নিষেধাজ্ঞা না মানলে কঠোর শাস্তিস্বরূপ জরিমানা করা হতে পারে। এমনকি জেল পর্যন্ত হতে পারে। একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক এবং প্লাস্টিকজাত পণ্য পরিবেশের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। সে কারণেই এ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে ভারত সরকার। প্লাস্টিকের ব্যাগ থেকে শুরু করে বিভিন্ন জিনিসের প্যাকেট সাধারণত একবার ব্যবহার করেই ফেলে দেয়া হয়।

তাই একে সিঙ্গেল ইউজড প্লাস্টিক বলা হয়েছে। গত বছর প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বা প্লাস্টিক ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট-সংক্রান্ত আইন সংশোধন করে একটি নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। একক-ব্যবহারের প্লাস্টিক খোলা অবস্থায় থাকলে তা থেকে বিষাক্ত রাসায়নিক নির্গত হয়। আর পরিসংখ্যান বলছে, পুরো বিশ্বে প্রতি মিনিটে প্রায় ১০ লাখ প্লাস্টিকের বোতল বা ব্যাগ ব্যবহার করা হয়। সিঙ্গেল ইউজড প্লাস্টিক বা প্লাস্টিকজাত পণ্য বিশ্বব্যাপী বিপদ ডেকে আনছে। কারণ এর জেরে আমাদের পারিপার্শ্বিক এলাকা অপরিচ্ছন্ন হয়ে ওঠে, যা পুরো জীবজগতের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। এমনকি ফেলে দেয়া প্লাস্টিক ও প্লাস্টিকজাত পণ্য নালা-নর্দমায় গিয়ে পড়ে এবং তা জমতে শুরু করে। ফলে নালা-নর্দমার মুখ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আর পানি মাটির নিচে প্রবেশ করতেও বাধা পায়। শুধু তা-ই নয়, প্লাস্টিকজাত বর্জ্য নদী এবং সাগরের তলদেশেও পৌঁছে যাচ্ছে। ফলে সামুদ্রিক জীবজন্তুর জীবনও বিপন্ন হয়ে উঠছে। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশ একক প্লাস্টিকের ব্যবহার সম্পূর্ণ কিংবা আংশিক নিষিদ্ধ করেছে। যার মধ্যে আফ্রিকা মহাদেশের ৩০টি দেশে প্লাস্টিকের ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ইউরোপে প্লাস্টিকের ব্যাগের ব্যবহারের ওপর আলাদা করে কর কিংবা চার্জ ধার্য করা হয়েছে। বাংলাদেশও ক্ষুদ্র ও একবার ব্যবহূত প্লাস্টিক বন্ধে আইন প্রণয়ন করতে পারে।

প্লাস্টিক বর্জ্যের কারণে সৃষ্ট ভয়াবহ অবস্থা থেকে উত্তরণে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে প্লাস্টিকের ব্যবহার অর্ধেকে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা তৈরি করেছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় করা ওই পরিকল্পনায় প্লাস্টিকের পুনর্ব্যবহার বাড়ানোর ওপরও জোর দেয়া হয়েছে। ২০২১-৩০ সালে প্লাস্টিকের ব্যবহার ও দূষণ নিয়ন্ত্রণে একটি কর্মপরিকল্পনাও করা হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে প্লাস্টিক পণ্যের উৎপাদন ৫০ শতাংশ কমিয়ে আনা, প্লাস্টিক বর্জ্য ৩০ শতাংশ কমানো এবং ২০২৬ সালের মধ্যে প্লাস্টিকের পুনর্ব্যবহার ৫০ শতাংশে উন্নীত করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পর এমন পরিকল্পনা তৈরি করা ইতিবাচক। তবে পরিকল্পনার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা জরুরি। অতীতে আইন করেও পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করা যায়নি। এজন্য পরিকল্পনা বাস্তবায়নে শঙ্কা থেকে যায়। পরিকল্পনা শুধু কাগজে-কলমে থাকলেই হবে না, এর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করতে হবে।
প্লাস্টিক বায়োগ্রেডেবল নয়, পরিবেশে মিশে যায় এবং ভেঙে ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণায় পরিণত হয়। সেজন্য মোটামুটি সব দেশই প্লাস্টিকের পুনর্ব্যবহার নিশ্চিত করেছে। গড়ে তুলেছে এর চক্রাকার অর্থনীতি। অর্থাৎ পণ্য তৈরি, ব্যবহার, বর্জ্য সংগ্রহ এবং পুনরায় এর ব্যবহার। চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া প্লাস্টিক রিসাইক্লিংয়ের অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠা করেছে। কিছু দেশ প্লাস্টিক পণ্য সংগ্রহ ডিপো এবং ফেলার স্থান নির্দিষ্ট রাখার জন্য ভোক্তাদের অর্থ প্রদানেরও ব্যবস্থা করেছে। যাতে ব্যবহার শেষে পণ্যগুলো যথাস্থানে ফেরত দিতে ভোক্তারা উৎসাহিত হন। যেহেতু বাংলাদেশের মানুষ অসচেতন, সেহেতু এ ধরনের কিছু উৎসাহমূলক পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। একই সঙ্গে শাস্তির ব্যবস্থাও থাকতে হবে। সর্বোপরি বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বাড়াতে হবে সক্ষমতা। জাপানে শিল্প-কারখানা থেকে শুরু করে গৃহস্থালি কাজে ব্যবহার শেষে নষ্ট হয়ে যাওয়া প্লাস্টিকসামগ্রী রিসাইকেল করা হয়। অনেক দেশে জৈব উপাদান ব্যবহার করে পচনশীল প্লাস্টিক তৈরির উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশও এমন মডেল অনুসরণ করতে পারে।

বাস্তবতা হলো, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আমাদের অবকাঠামো ও জনবলগত ঘাটতি আছে। সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মীরা গৃহস্থালি বর্জ্য সংগ্রহে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন। তার মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে বেড়ে চলা ওয়ানটাইম প্লাস্টিক উপকরণের ব্যবহার তাদের কাজ আরো কঠিন করে তুলেছে। এ প্রেক্ষাপটে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অবকাঠামো ও জনবল তো বাড়াতে হবেই, এর সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদে প্লাস্টিকের টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতে নীতিগত কিছু হস্তক্ষেপের বিষয়েও ভাবনা-চিন্তা জরুরি। দেশের পরিবেশ রক্ষায় সুষ্ঠু প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য অবশ্যই আইন প্রণয়ন করে তা দ্রুত বাস্তবায়ন দরকার। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন করতে হলে সবার আগে প্রয়োজন সঠিক নিয়মে বর্জ্য সংগ্রহের হার বৃদ্ধি উপযোগী ও উন্নত বর্জ্য পরিবহন পদ্ধতি, সঠিক স্থানে ড্যাম্পিং এবং জনস্বাস্থ্যের প্রতি হুমকি সৃষ্টি না হয়—এমন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি কাজে লাগানো। পরিবেশ রক্ষায় প্লাস্টিক বর্জ্যের টেকসই ব্যবস্থাপনার কোনো বিকল্প নেই।

এই ওয়েবসাইটের সকল লেখার দায়ভার লেখকের নিজের, স্বাধীন নিউজ কতৃপক্ষ প্রকাশিত লেখার দায়ভার বহন করে না।
এই বিভাগের আরও খবর
- Advertisment -

সর্বাধিক পঠিত

- Advertisment -