নিজের বেতনের টাকা স্কুলের সৌন্দর্যবর্ধনে জন্য ব্যয় করেন শিক্ষক অলি উল্লাহ

ডেস্ক রিপোর্ট

সম্প্রতি স্থানীয় এক গাঁয়ের মাটির রাস্তা দিয়ে রাতে মটর সাইকেলে চড়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ ফসলের মাঠে অবস্থিত নানা রঙ ও চিত্রকর্মে ভরপুর আলোকসজ্জিত এক দৃষ্টিনন্দন ভবনের দিকে চোখ পড়ে। ভবনের আঙ্গিনায় জ¦লছে সাত রঙের সারিবদ্ধ প্যানেল লাইট ও সারা মাঠ জুড়ে উড়ছে সাত রঙের অনেকগুলো ফেসটিবল পতাকা। প্রথমে মনে হল এখানে স্থানীয় কোন অনুষ্ঠানের জন্য হয়তো এ আয়োজন। কৌতুহলী হয়ে একটু কাছে গিয়ে দেখা গেল ভবনের সামনে দেয়ালে একটি ডিজিটাল লাইটিং সাইনবোর্ড। তাতে লেখা ভেসে উঠে একটি স্কুলের নাম। অজপাড়া গাঁয়ে আধুনিক স্কুলের এমন চিত্র বিরল ঘটনা। এ দৃশ্য দেখে তখন মনে প্রশ্ন জাগে কিভাবে এটা সম্ভব হল। বলছি ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার অচিন্তপুর ইউনিয়নের ডেকুরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কথা।

এ সৌন্দর্যবর্ধন কাজ বাস্তবায়নের রূপকার হচ্ছেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ অলি উল্লাহ। যিনি প্রতি মাসে নিজের বেতনের একাংশ টাকা ব্যয় করেন স্কুলের উন্নয়নে। মাত্র চার বছরের আন্তরিক প্রচেষ্টায় তিনি জরাজীর্ণ স্কুলের চিত্র পাল্টে দিয়ে অবহেলিত এ প্রতিষ্ঠানকে একটি আধুনিক মডেল স্কুলে রূপান্তর করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। অলি উল্লাহ’র এমন কাজে মুগ্ধ স্থানীয় অভিভাবক, এলাকাবাসী, শিক্ষকসহ শিক্ষা অফিসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণ। স্কুলের এ সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য সকলের কাছে বর্তমানে প্রশংসার জোয়ারে ভাসছেন ওই শিক্ষক।
একদিন সরজমিনে স্কুলটি পরিদর্শন করে দেখা যায়, স্কুলের প্রধান দরজার পাশে স্থাপন করা থাইলসে অঙ্কিত বাংলাদের মানচিত্র। লাল-সবুজ রঙে স্কুলের নতুন ও পুরাতন ভবনের দেয়ালে শোভা পাচ্ছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলাদের বিশিষ্ট কবি-সাহিত্যিকের ছবিসহ মুক্তিযুদ্ধ ও বিভিন্ন শিক্ষামূলক চিত্রকর্ম। ভবনের মূল দরজার উপরে দেয়ালে ফিটিং করা হয়েছে ডিজিটাল ঘড়ি ও ডিজিটাল লাইটিং সাইনবোর্ড। স্কুলের মাঠের দু’পাশে ও ভবনের ছাদে রয়েছে বিভিন্ন শাক-সবজি ফুলের বাগান। স্কুলের শিক্ষার্থীরা পরিচর্চা করে থাকে এ বাগান। স্কুলের শ্রেণিকক্ষ, দাপ্তরিক রুম পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন পরিপাটি করে সাজানো গুজানো। ওয়াসব্লকগুলো পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন ও দুর্গন্ধমুক্ত। রয়েছে পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানির সু-ব্যবস্থা। স্কুলের শ্রেনিকক্ষসহ বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করা হয়েছে সি.সি ক্যামেরা। রয়েছে আরও অনেক শিক্ষা উপকরন ও শিক্ষামূলক চিত্রকর্ম।

ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার অচিন্তপুর ইউনিয়নের ডেকুরা গ্রামে ১৯৭১ সনে এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি স্থাপিত হয়। পৌর শহর থেকে ৯ কিলোমিটার দূরের বিদ্যালয়টিতে যাওয়ার রাস্তাটি দুর্গম।

স্কুলের কয়েকজন অভিভাবক জানান, প্রধান শিক্ষক অলি উল্লাহ প্রায় চার বছর হয়েছে এ স্কুলে যোগদান করেন। এর আগে স্কুলটির অবস্থা ছিল জরাজীর্ণ ও অবহেলিত। শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি তেমন ছিলনা। তিনি যোগদানের পর থেকেই পাল্টে যেতে থাকে স্কুলের পরিবেশ। এই সময়ের মাঝে সরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন বরাদ্দের সঙ্গে নিজের বেতনের একাংশ ব্যয় করে অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে স্কুলটিকে দৃষ্টিনন্দন আধুনিক স্কুলে রূপান্তর করেছেন তিনি। এখন স্কুলে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি সন্তোষজনক। প্রধান শিক্ষকের প্রবল ইচ্ছা ও আগ্রহের সাথে একমত পোষণ করে আধুনিক মডেল স্কুল নির্মাণে বর্তমানে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন স্থানীয় শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিবর্গ।
স্কুলের জমিদাতা মৃত হাজী আব্দুর রশিদের ছেলে প্রবাসী মোঃ উবায়েদ উল্লাহ জানান, এ উপজেলায় অন্যান্য স্কুলের তুলনায় এ স্কুলটির উন্নয়ন বরাদ্দ অনেক কম। অন্যান্য স্কুলগুলোতে উন্নয়ন বরাদ্দ বেশি হলেও নাম মাত্র কাজ হয়ে থাকে। অথচ সামান্য বরাদ্দের সাথে শিক্ষক অলি উল্লাহ নিজের বেতনের টাকা যোগ করে অল্প সময়ে ডেকুরা স্কুলের যে পরিবর্তন দেখিয়েছেন তা সকলকে মুগ্ধ করেছে।

এসময় তিনি স্কুলের আধুনিকায়নকল্পে শিক্ষক ও জনবলের পদ বৃদ্ধিকরন, শ্রেনি কক্ষে বেঞ্চ ও প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ সংকট নিরসন, বাউন্ডারি দেয়াল নির্মাণ ও উপজেলা সদরের সাথে স্কুলের যোগাযোগের স্থানীয় ইছুলিয়া গ্রাম থেকে ডেকুরা পর্যন্ত প্রায় দুই কিঃ মিঃ রাস্তা পাকাকরনের দাবি করেন।

স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ অলি উল্লাহ জানান, এখানে যোগদানের সময় জরাজীর্ণ স্কুলটিতে পাঠদানের পরিবেশ না থাকায় শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি তেমন ছিলনা। তাই শিশুদের স্কুলমুখী ও শিক্ষাগ্রহনে মনযোগী করতে পরিকল্পনা করেন স্কুলটি সুন্দর এবং পরিপাটি করে সাজানোর। কিন্তু সরকারি সামান্য উন্নয়ন বরাদ্দের টাকায় এটি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এ পরিকল্পনার বিষয়টি উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মনিকা পারভীনকে অবগত করা হলে তিনি স্কুলটি আধুনিকায়নকল্পে পরামর্শ ও সার্বিক সহযোগিতার আশ^াস দেন। এরপর উন্নয়ন বরাদ্দের সঙ্গে নিজের বেতনের একাংশের টাকা যোগ করে শুরু করেন এর বাস্তবায়ন কাজ। আর এভাবে মাত্র চার বছরে এ প্রতিষ্ঠানকে একটি দৃষ্টিনন্দন আধুনিক স্কুলে রূপান্তর করেন তিনি। বর্তমানে স্কুলে শিক্ষার্থীর উপস্থিতির হার শতকরা ৯৫ ভাগ। তারা সব বিষয়ে পারদর্শী।

তিনি আরও জানান, স্কুলটি আধুনিক ও শিক্ষাবান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে আরও অনেক কাজ এখনো বাকী আছে। কিন্তু অপ্রতুল বরাদ্দে তা বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছেনা। এদিকে নিজের বেতনের অনেক টাকা স্কুলের উন্নয়ন কাজে ব্যয় করে রীতিমত সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাঁকে। এক্ষেত্রে স্কুলে সরকারি বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবি করেন তিনি।

উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ আব্দুর রাশিদ জানান, স্কুলের উন্নয়নকল্পে প্রধান শিক্ষক অলি উল্লাহ অগ্রিম টাকা ব্যয় করেছেন। সরকারি উন্নয়ন বরাদ্দ বৃদ্ধির মাধ্যমে এক/দুই বছরের মধ্যে ওই শিক্ষকের অগ্রিম ব্যয়ের সমন্বয় করা হবে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবগত করা হয়েছে বলে তিনি জানান

এই ওয়েবসাইটের সকল লেখার দায়ভার লেখকের নিজের, স্বাধীন নিউজ কতৃপক্ষ প্রকাশিত লেখার দায়ভার বহন করে না।
এই বিভাগের আরও খবর
- Advertisment -

সর্বাধিক পঠিত

- Advertisment -