ফয়সাল আহমেদ
নদীমাতৃক দেশে নদীই এখন সবচেয়ে বেশি অবহেলার শিকার। দখল-দূষণ আর দায়িত্বহীনতার কারণে এরই মধ্যে হারিয়ে গেছে অনেক নদী। সংখ্যার হিসেবে তা ঠিক কত, আমাদের জানা নেই। গণমাধ্যম সূত্রে প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও নদী দখল কিংবা দূষণের সংবাদ পাওয়া যায়। এ দখলের তালিকায় স্থানীয় প্রভাবশালী, রাজনৈতিক নেতা কিংবা বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠান কেউ বাদ যায়নি। কোথাও কোথাও এমনও হচ্ছে নদীকে খাল দেখিয়ে প্রকল্প তৈরি করে সেই খাল খননের নামে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালী ব্যক্তি। সেখানে আবার অর্থায়ন করছে দাতা সংস্থা। দূষণের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমেই ভরাট হচ্ছে নদী। ধীরে ধীরে মানচিত্র থেকেও মুছে যাচ্ছে শেষ চিহ্নটুকুও। সংগত কারণেই কমছে নদ-নদীর সংখ্যা।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে নদীর সঠিক সংখ্যা কত তারও কোনো নিশ্চিত উত্তর আমাদের কাছে নেই। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক নদী দিবসে দেশের নদ-নদীর তালিকা প্রকাশ করে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। কমিশনের তথ্যমতে, দেশে নদ-নদীর সংখ্যা ১ হাজার ৮টি। রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘বাংলাদেশের নদ-নদী: সংজ্ঞা ও সংখ্যা’ বিষয়ক সেমিনারে এ তালিকা প্রকাশ করে কমিশন। যদিও এ তালিকা নিয়ে এরই মধ্যে নদীকর্মী ও বিশেষজ্ঞরা আপত্তি জানিয়েছেন। কেউ কেউ এ তালিকা বাতিল করার কথা বলছেন। সরকারের আরেক সংস্থা বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বাপাউবো) কর্তৃক ২০১১ সালে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের নদ-নদী’ বইতে ৪০৫টি নদীর উল্লেখ রয়েছে। অন্যদিকে নদীবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের গবেষণা বলছে, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ও বাংলাদেশে ১২শ নদী ছিল। তাহলে পাঁচ দশক পর এসে নদীর মোট সংখ্যা কত দাঁড়িয়েছে তার সঠিক হিসাব কিংবা তালিকা আজও প্রস্তুত হয়নি।
এই যে পানির দেশে, নদীর দেশে নদীর প্রতি অবহেলা তা কোনোভাবে আমাদের প্রাণ-প্রকৃতির জন্য মঙ্গলজনক নয়। উচিত হচ্ছে, দেশের নদ-নদী সুরক্ষায় রাষ্ট্রের অতীব যত্নবান হওয়া। আর সেটা নিশ্চিত করার পেছনে মূল ভূমিকা রাখতে পারে রাজনৈতিক সদিচ্ছা। সত্যি বলতে কী রাজনৈতিক দলগুলো আন্তরিকভাবে না চাইলে নদী সুরক্ষা সম্ভব নয়। তাই আমরা চাই রাজনৈতিক দলগুলো তাদের এজেন্ডার অগ্রভাগে রাখুক নদী সুরক্ষার অঙ্গীকার। নদী জায়গা করে নিক তাদের ইশতেহারের পাতায়।
আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দৃশ্যমান প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। যদিও নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে কিংবা কার অধীনে হবে, এসব বিষয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভিন্নমত থাকায় বিএনপিসহ একাধিক রাজনৈতিক দল এখনো রাজপথে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটের শরিক দলগুলো নির্বাচনের পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি দলটি শুরু করেছে নির্বাচনী ইশতেহার তৈরির কাজ। সে লক্ষ্যে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. মো. আবদুর রাজ্জাককে আহ্বায়ক ও তথ্য এবং গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদকে সদস্য সচিব করে গঠন করা হয়েছে ইশতেহার প্রণয়ন উপকমিটি। এরই মধ্যে সেই কমিটি তাদের কাজও শুরু করে দিয়েছে। এরই মধ্যে তারা দেশের বিভিন্ন খাত সম্পর্কে ইশতেহারে কী কী বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে এবং আবারো সরকার গঠন করলে কী কী নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে এ বিষয়ে মতামত চেয়ে একটি গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছে।
নদীর প্রশ্নে যেকোনো রাজনৈতিক দলই নির্বাচন সামনে রেখে প্রকাশিত ইশতেহারে এর পূর্ণ সুরক্ষার অঙ্গীকার করবে, এটি অন্যায্য কোনো দাবি নয়। নদীকে সুরক্ষা দিতে দখল-দূষণ বন্ধ করা, অবাধে বালি উত্তোলন বন্ধ ও ভাঙন প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দলগুলোর জোরালো কমিটমেন্ট থাকা দরকার, অন্যথায় নদ-নদী সুরক্ষা শুধু স্বপ্ন হয়েই থেকে যাবে।
আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন (২০২৪) সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলো যে ইশতেহার প্রস্তুত করছে কিংবা করবে তাতে নদীর সুরক্ষার প্রশ্নে যে বিষয়গুলো যুক্ত হতে পারে তার একটি প্রস্তাবনা নিম্নে যুক্ত করা হলো—
১. সংসদ সদস্য ও অন্যান্য জনপ্রতিনিধিকে নদী সুরক্ষার বিষয়ে সচেতন করা। এ লক্ষ্যে তাদের প্রশিক্ষণ দেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ।
২. নির্বাচিত হলে দলের কোনো সংসদ সদস্য নদী দখল কিংবা পরিবেশের জন্য হুমকি এমন কোনো কাজে যুক্ত থাকলেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
৩. আদালত কর্তৃক ঘোষিত নদীর আইনগত অভিভাবক প্রতিষ্ঠান জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের বিদ্যমান আইন সংশোধন করে শক্তিশালী করা। একই সঙ্গে কমিশনকে একটি স্বাধীন ও কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ।
৪. জেলা, উপজেলা ও বিভাগীয় নদী রক্ষা কমিটিকে সক্রিয় করার অঙ্গিকার।
৫. নদী তীরের সাধারণ সচেতন মানুষকে নিয়ে গ্রাম, ইউনিয়ন কিংবা পৌরসভাকেন্দ্রিক নদী সুরক্ষা কমিটি তৈরি করার উদ্যোগ গ্রহণ। যে কমিটিগুলো নদীকেন্দ্রিক সরকারের সব কর্মকাণ্ড নজরদারি করবে।
৬. বিগত দিনে নদীর দখল ও দূষণ রোধে নির্দেশনা চেয়ে উচ্চ আদালতে করা রিটের বিপরীতে আদালত যেসব রায় ও নির্দেশনা দিয়েছেন তার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার অঙ্গীকার গ্রহণ।
৭. সারা দেশে সিএস ও আরএস ম্যাপ অনুযায়ী নদীগুলোর সীমানা জরিপ করে সীমানা পিলার স্থাপন, প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রণয়ন ও দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ।
৮. নদী তীরবর্তী কলকারখানা, বাজার ও স্যুয়ারেজের বর্জ্য নদীতে ফেলা বন্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ। একই সঙ্গে নদী তীরবর্তী সব কলকারখানার ইটিপি (ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট) কার্যকর করতে হবে। অন্যথায় আইনি ব্যবস্থা।
৯. সাম্প্রতিক সময়ে নদীগুলোয় হঠাৎ দেশী মাছের জন্য ক্ষতিকারক ‘সাকার’ মাছের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই সাকার মাছের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতকরণ ও দেশীয় মাছ রক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ।
১০. নদী তীরে পরিবেশবান্ধব বৃক্ষরোপণ ও নদী, খাল বা জলাধার থেকে প্লাস্টিক জাতীয় বর্জ্য সরানোর বিষয়ে উদ্যোগ নেয়ার অঙ্গিকার।
১১. স্থানীয় পর্যায়ে জরিপ করে আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোর সঠিক তালিকা প্রকাশ ও পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের অঙ্গীকার।
নির্বাচন উপলক্ষে ইশতেহার প্রকাশ নতুন কিছু নয়। প্রতিটি রাজনৈতিক দলই জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করে জনগণের কাছে ভোট প্রার্থনা করে। এ ইশতেহারে দেশ নিয়ে সংশ্লিষ্ট দলটির চিন্তা-চেতনা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, মানবসম্পদ, আত্মকর্মসংস্থান, নারীর ক্ষমতায়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, কৃষি, অর্থনীতি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সম্পদ, যোগাযোগ খাত, শিল্প উন্নয়ন, প্রবাসী কল্যাণ, ক্রীড়া ইত্যাদি নানা বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দলটির কর্মপরিকল্পনায় ভরে ওঠে ইশতেহারের পাতা। সেখানে গুরুত্বের সঙ্গে জায়গা পাক নদী সুরক্ষার প্রসঙ্গ। আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
ফয়সাল আহমেদ: সম্পাদক, ‘এবং বই’ ও ‘রিভার বাংলা’