বাঁশখালীর নতুন বেড়িবাঁধ ভাঙছে জলোচ্ছ্বাস ছাড়াই!

0
2


উজ্জ্বল বিশ্বাস, বাঁশখালী (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি

বাঁশখালীর খানখানাবাদ উপকূলে ২৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বেড়িবাঁধে ভাঙন ও ফাটল। ছবি : কালের কণ্ঠ

উপকূলবাসীর জানমালের নিরাপত্তায় বাঁশখালী স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের (২০১৫-১৭) বাঁধটি জলোচ্ছ্বাস ছাড়াই ভাঙতে শুরু করেছে। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২৯৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণকাজ শেষ করে ২০২২ সালে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান বাঁধটি বুঝিয়ে দেয় পানি উন্নয়ন বোর্ডকে (পাউবো)। এরই মধ্যে খানখানাবাদ উপকূলের কদমরসুল গ্রামে ১০ দিন ধরে জোয়ার-ভাটার স্রোতে বেড়িবাঁধটি ভাঙতে শুরু করায় এলাকাবাসী আতঙ্কে রয়েছে। স্থানীয়রা দাবি করছে, বেড়িবাঁধ নির্মাণে দুর্নীতি এবং নকশায় ত্রুটি থাকায় শত শত কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা স্থায়ী বেড়িবাঁধটি ভেঙে যাচ্ছে।

সরেজমিনে বাঁশখালীর খানখানাবাদ কদমরসুল গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানকার মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। ১৯৯১ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে ঘরবাড়ি ও স্বজন হারানো মানুষগুলো স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণ হওয়ায় নানা স্বপ্ন দেখছিল। গ্রামে গ্রামে নতুন ঘরবাড়ি তোলা হয়েছে। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ বেড়িবাঁধটির খানখানাবাদ কদমরসুল গ্রামের অংশ ভাঙতে শুরু করায় উপকূলজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।

কদমরসুল গ্রামে বঙ্গোপসাগর ও সাঙ্গু নদীর মোহনায় প্রায় এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বেড়িবাঁধ ভেঙে বঙ্গোপসাগরে তলিয়ে যাচ্ছে। ভেঙে পড়া বেড়িবাঁধের পাশে পানির প্রবাহের গভীরতা ১০০ থেকে ১৩০ ফুট। এর বিপরীত অংশে বঙ্গোপসাগরে জেগে উঠেছে প্রায় দুই বর্গকিলোমিটার সমুদ্র বালুচর। অদূরেই চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর এবং আনোয়ারা উপজেলার পারকিচর পর্যটনকেন্দ্র।

বেড়িবাঁধ নির্মাণে ভুল নকশা, সমুদ্রে জেগে ওঠা বালুচর এবং সাঙ্গু নদীর প্রবহমান পানির গতিপথ পাল্টে বেড়িবাঁধের ওপর আছড়ে পড়ছে। ফলে সামান্য জোয়ার-ভাটায় প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকায় বাঁধে ফাটল তৈরি হচ্ছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ভাঙন  ঠেকাতে সেখানে কিছু শ্রমিক জিও ব্যাগ (বালুভর্তি) বেড়িবাঁধে ফেলছে। শ্রমিকরা জানান, জিও ব্যাগ ফেলার সঙ্গে সঙ্গে তা সাগরের ১০০ ফুট কিংবা ১৩০ ফুট গভীরে তলিয়ে যাচ্ছে। জিও ব্যাগ নয়, জেগে ওঠা বালুচর দ্রুত ড্রেজিং (খনন) করা দরকার।

চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার উপকূলে ১৯৯১ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে মারা গেছে প্রায় এক লাখ ৩৮ হাজার মানুষ। এর মধ্যে ভাঙা বেড়িবাঁধের কারণে শুধু বাঁশখালীতে প্রাণ হারায় ৪০ হাজার মানুষ।
খানখানাবাদ ও ছনুয়া এলাকার বাসিন্দা আলী নবী, আব্দুল কাদের, রোকন উদ্দিনসহ আরো অনেকে জানান, ২০১৫ সালে বাঁশখালীতে বেড়িবাঁধ নির্মাণকাজ শুরু হলে কাজ শেষ হয় ২০২২ সালে। সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার নানা কৌশলে এই প্রকল্পে দুর্নীতি করেছে। বেড়িবাঁধ রক্ষায় বাঁধের ঢালু অংশে পর্যাপ্ত ঘাস ও গাছ লাগানোর কথা ছিল, কিন্তু তা করা হয়নি। ব্লক নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে নিম্নমানের পাথর, ইট, সিমেন্ট ও বালু। ফলে এরই মধ্যে বেশির ভাগ সিসি ব্লক ভেঙে গেছে। বিস্তীর্ণ বেড়িবাঁধজুড়ে ভাঙা সিসি ব্লক দৃশ্যমান।

খানখানাবাদের কদমরসুল এলাকা ও ছনুয়া এলাকায় বেড়িবাঁধের নির্মাণকাজ করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হাসান অ্যান্ড ব্রাদার্স। নির্মাণকাজ চলার সময় গ্রামবাসী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দৃষ্টিতে বিষয়টি আনলেও তারা আমলে নেয়নি।

এসব অভিযোগ সম্পর্কে হাসান অ্যান্ড ব্রাদার্সের দায়িত্বে থাকা ব্যবস্থাপক রুদ্র শাহরিয়ার বলেন, ‘বেড়িবাঁধ নির্মাণে কোনো ধরনের অনিয়ম করা হয়নি। সমুদ্রে জেগে ওঠা চর খনন করা না হলে এই বেড়িবাঁধ রক্ষা করা কঠিন হবে। এটা নকশার ত্রুটি। আমাদের কোনো গাফিলতি নেই।’

খানখানাবাদ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিন হায়দার বলেন, খানখানাবাদে ভয়াবহভাবে বেড়িবাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। জিও ব্যাগ ফেলেও বেড়িবাঁধ রক্ষা করা যাচ্ছে না। সমুদ্রে জেগে ওঠা বালুচর দ্রুত খনন করলে খানখানাবাদবাসী বেঁচে যায়। আর বেড়িবাঁধ নির্মাণে নকশা সংশোধন করতে হবে। সাঙ্গু নদীর সৃষ্ট কৃত্রিম গতিপথ পাল্টিয়ে প্রাকৃতিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে।

পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদ উজ-জামান খান বলেন, ‘বাঁশখালীর খানখানাবাদে নির্মাণ করা নতুন বেড়িবাঁধের পাশে বঙ্গোপসাগরে জেগে ওঠা বালুচরের কারণে সাঙ্গু নদীর পানির গতিপথ পাল্টে বেড়িবাঁধে ঢেউ আছড়ে পড়ায় বাঁধ ভাঙছে। আমরা বেশ কয়েকবার নকশার জরিপ করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবহিত করেছি। সমুদ্রচর ড্রেজিং হলে বেড়িবাঁধটি রক্ষা হবে। ভাঙন ঠেকাতে ২০ হাজার জিও ব্যাগ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।’ ঠিকাদারের দুর্নীতির বিষয়ে তিনি কিছু বলতে রাজি হননি।

বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জেসমিন আক্তার বলেন, ‘খানখানাবাদের কদমরসুল গ্রামে বেড়িবাঁধ ভাঙন এলাকা ঘুরে দেখেছি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের বিষয়টি দেখে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। সমুদ্রে জেগে ওঠা বালুচর খননের বিষয়ে পদক্ষেপ নিতেও বলা হয়েছে।’

বাঁশখালী উপজেলার বঙ্গোপসাগর ও সাঙ্গু নদীর পারে ১৪ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ প্রকল্প একনেকে পাস হয় ২০১৫ সালে। ব্যয় ধরা হয় ২৫১ কোটি ২৯ লাখ টাকা। কয়েক দফা সময় ও ব্যয় বাড়িয়ে করা হয় ২৯৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা। প্রকল্পের আওতায় ৬.২ কিলোমিটার বাঁধের ঢাল সংরক্ষণ, ভাঙন রোধ ও পুনরাকৃতিকরণ, ৩.৮ কিলোমিটার নদীর তীর সংরক্ষণ এবং ৫.৬ কিলোমিটার বাঁধ পুনরাকৃতিকরণ করার কথা ছিল।