
মতামত ডেস্ক।
খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থায় রয়েছে। এতে কষ্টে দিনাতিপাত করছে নিম্ন আয়ের মানুষ। বাজারে কোনো পণ্যেই স্বস্তি ফেলার অবকাশ নেই। এ রকম দুর্বিষহ অবস্থায় সরকারের পক্ষ থেকে তিনটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দেয়া হয়। কিন্তু তার কোনো ছাপ বাজারে পড়ছে না। এতে সাধারণ মানুষের মনে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। বাজার ব্যবস্থাপনায় সরকারের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
বণিক বার্তায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, প্রথমবারের মতো আলু, পেঁয়াজ ও ডিমের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এর আগে সরকারের পক্ষ থেকে ভোজ্যতেল ও চিনির দামও নির্ধারণ করে দেয়া হয়। তবে নির্ধারিত মূল্যে বাজারে এসব পণ্য পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। নতুন করে দাম বেঁধে দেয়া হলেও ডিম, আলু ও পেঁয়াজ অনেকটা আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে।
বিক্রেতারা অভিযোগ করে বলছেন, তারা বেশি দামে কিনছেন বলেই সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি করা যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, নতুন তিন ভোগ্যপণ্যের দাম নির্ধারণ করে নিয়মিত তদারকি না করলে তা চিনি ও ভোজ্যতেলের মতো শুধু ঘোষণায়ই সীমাবদ্ধ থাকবে। কারণ এর আগেও পণ্যের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু সরকার সেভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। এজন্য নতুন নির্ধারিত পণ্যের ক্ষেত্রেও সেটা হওয়ার শঙ্কাই বেশি।
গত বৃহস্পতিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রতি কেজি আলুর সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ৩৫-৩৬ টাকা, দেশী পেঁয়াজ ৬৪-৬৫ টাকা এবং প্রতিটি ডিমের মূল্য ১২ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। এছাড়া প্যাকেটজাত সয়াবিন ও খোলা সয়াবিনের দাম লিটারে ৫ টাকা কমিয়ে যথাক্রমে ১৬৯ ও ১৪৯ টাকা এবং পাম অয়েলের দাম লিটারে ৪ টাকা কমিয়ে ১২৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
যদিও পরের দিন শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, আলু প্রতি কেজি খুচরায় ৪৮-৫২ টাকা, পাবনার পেঁয়াজ ৮৫-৯০ টাকা, ফরিদপুরের পেঁয়াজ ৭৫-৮৫ টাকা এবং প্রতি পিস ডিম সাড়ে ১২ থেকে ১৩ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ সরকার নির্ধারিত মূল্যের কোনো প্রভাব বাজারে পড়েনি। এমনকি নতুন নির্ধারিত পণ্যের পাইকারি বাজারমূল্যও অপরিবর্তিত রয়েছে। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে ৫০ কেজির প্রতি বস্তা পাবনার পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৮৫০ থেকে ৩ হাজার ৯০০ টাকা। আর ফরিদপুরের ৫০ কেজির প্রতি বস্তা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৪০০ থেকে ৩ হাজার ৬০০ টাকায়। অর্থাৎ প্রতি কেজি পাবনার পেঁয়াজ ৭৭-৭৮ টাকা এবং ফরিদপুরের পেঁয়াজ ৬৮-৭২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আলু বিক্রি হচ্ছে পাঁচ কেজির প্রতি পাল্লা ২২০-২৪০ টাকায়। অর্থাৎ প্রতি কেজি আলুর পাইকারি দাম পড়ছে ৪৪-৪৮ টাকা। ফার্মের ডিম বিক্রি হচ্ছে প্রতি হালি ৫০ টাকায়। এক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা বেশি দামে কেনার অভিযোগই করছেন।
অন্যদিকে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযানে বেশি দামে পণ্য কেনার রসিদ দেখাতে পারেননি চট্টগ্রামের আলু বিক্রেতারা। এজন্য ব্যবসায়ীদের সচেতনতার ওপর জোর দেয়ার বিষয়টি বলা হচ্ছে। এছাড়া রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় আলু, পেঁয়াজ ও ডিমসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম স্থিতিশীল ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার জন্য অভিযান পরিচালনা করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। অভিযানে জরিমানাও করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। কিন্তু বাজারে প্রভাব না পড়ার কারণ হিসেবে নানা বিষয় উঠে আসছে। বিশেষ করে আগের কেনা পণ্য নতুন মূল্যে বিক্রি করা হলে লোকসান হবে বলে ব্যবসায়ীরা দাবি করছেন।
আবার সারা দেশে অভিযান পরিচালনা করলেও ভোক্তা অধিকারের যথেষ্ট লোকবলের অভাব রয়েছে বলে স্বয়ং বাণিজ্যমন্ত্রী স্বীকার করেছেন। তবে তিনটি প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের দাম মনিটরিং করা হচ্ছে বলে তিনি দাবি করেন। বিশেষ করে বাজারে কোনো কারণ ছাড়াই প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে গেছে এটিও তিনি উল্লেখ করেছেন।
এখন মোদ্দা কথা হচ্ছে সরকারের ওপর জনগণের আস্থা বজায় রাখতে হবে। এটিও সত্য যে মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সবসময় ব্যবসায়ীদের চাপে রাখা সম্ভব নয়। কিন্তু বাজার ব্যবস্থাপনায় তো নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলা যাবে না। এতে সাধারণ জনগণের অপরিসীম ভোগান্তি হচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের যে সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে, তা ভাঙতে তৎপরতা প্রয়োজন। এটি না করে শুধু অভিযান পরিচালনা করে ব্যবসায়ীদের জরিমানা করলে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাওয়া যাবে না। এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ীর তৎপরতা আমরা দীর্ঘদিন ধরেই লক্ষ করছি। এদের সিন্ডিকেশন দমন না করে দাম নির্ধারণ করলে যে কোনো সুফল পাওয়া যায় না, নিকট অতীতেও সেটি ফুটে উঠেছে। তাই এখন বাজার নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। এজন্য যথাযথ প্রক্রিয়ায় ব্যবস্থা নিতে হবে। বাজারে খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি প্রয়োজনে বিদেশ থেকে আমদানির অনুমতি দিতে হবে। পাশাপাশি নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের জন্য ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশকেও (টিসিবি) আরো সক্রিয় করা উচিত।