মশার কাছে আর কত পরাজয়?

0
6


ড. কবিরুল বাশার

ছবি : সংগৃহীত

দীর্ঘদিন ধরে মশা নিয়ে কাজ করার কারণে পত্রিকা, টেলিভিশন চ্যানেলগুলো আমাকে প্রতিদিনই ফোন করে ডেঙ্গু-এর বাহক মশার নানান বিষয় সম্পর্কে জানতে চায়। পত্রিকার সংবাদকর্মীরাও জাতিকে একটি ভালো খবর দিতে চায়। ‘ডেঙ্গু এখন নিয়ন্ত্রণে’ এমন একটি হেডলাইন তারাও লিখতে চায়। আমার কাছেও জানতে চায় কবে নাগাদ কমবে ডেঙ্গু। সেই উত্তর আমিও খুঁজি।

প্রতিনিয়ত পত্রিকা থেকে অনুরোধ আসে ডেঙ্গু বিষয়ক লেখা দেওয়ার। ইদানীং ডেঙ্গু নিয়ে কারও সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। সংবাদকর্মীদের ফোন ধরে একটা কথাই বলি ‘২৪ বছর ধরে মশা নিয়ে গবেষণা করে বিদেশ থেকে মশার ওপর ডক্টরেট ডিগ্রি করে কী করতে পারলাম? দেশের মানুষকে ডেঙ্গু থেকে বাঁচাতে পারছি না।’


যেদিন ২৪ ঘণ্টায় ২১ জন মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেল সেইদিন মারাত্মকভাবে হতাশ হলাম। বুকের ভেতর এক বিশাল চাপ অনুভব করলাম। ২৪ ঘণ্টায় ২১ জন মানুষের মৃত্যু মেনে নেওয়া যায়? বিবেকের কাছে একটা প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আসছিল ‘কী করতে পারলাম দেশ-জাতির জন্য?’

দীর্ঘ ২৪ বছর ধরে অনেক গবেষণা করলাম, লিখলাম, বললাম বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশনে, কিন্তু কোনো ফলাফল তো আসলো না। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন এবং পরিচিতিজনও জিজ্ঞেস করে, কী করলে? আসলে তো কিছুই করতে পারিনি। যদি কিছু করতেই পারতাম তাহলে কি এত মানুষ ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হতো? এইসব হতাশা ভর করে মাথায়। হতাশার চাদর থেকে নিজেকে বের করে লিখতে বসলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম হতাশ হলে চলবে না, যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে আমৃত্যু।


লিখতে লিখতেই আরেকজন সাংবাদিক জানাল, দক্ষিণখান এলাকায় একটা বাড়িতে ২৬ জন সদস্যের মধ্যে পর্যায়ক্রমে ১৭ জন সদস্য ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। খবরটি শোনার পর কষ্ট পেলাম এবং ওই পরিবারের মানুষদের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করলাম।

…বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন এবং পরিচিতিজনও জিজ্ঞেস করে, কী করলে? আসলে তো কিছুই করতে পারিনি। যদি কিছু করতেই পারতাম তাহলে কি এত মানুষ ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হতো?

যদি তারা সচেতন এবং সম্পৃক্ত হতো তাহলে পরপর এতজন মানুষ আক্রান্ত হতো না। সাংবাদিক জানতে চাইল ‘কেন এতগুলো মানুষ একই বাড়িতে আক্রান্ত হলো এবং তাদের কী করার ছিল?’ একই বাড়িতে যখন একাধিক ব্যক্তি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় এবং তার মধ্যে যদি পাঁচ বছরের নিচে কোনো শিশু থাকে তাহলে নিশ্চিত ধরে নেওয়া যায় সেই বাড়ি বা পাশের বাড়িতে নিয়মিতভাবে এডিস মশার প্রজনন হচ্ছে। ওই এডিস মশাগুলো একজন থেকে আরেকজনকে কামড়িয়ে ডেঙ্গু ভাইরাস ছড়িয়ে যাচ্ছে।


স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে তাহলে করণীয় ছিল কী? করণীয় হলো মশা এবং ভাইরাসের মধ্যে সম্পর্ককে ভেঙে দেওয়া। যখন একজন ব্যক্তি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলো সঙ্গে সঙ্গে তাকে মশারির ভেতরে রাখা নিশ্চিত করতে হবে। অথবা ওই বাড়িতে থাকা সমস্ত মশা এরোসল দিয়ে মেরে ফেলা ও ওই বাড়ির যেখানে থেকে মশা জমেছে সেই জায়গাটা পরিষ্কার করে দিয়ে নিশ্চিত করা যেন সেই জায়গায় আর পানি না জমে।

ওই বাড়িতে থাকা মানুষজনের দিনে বা রাতে ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার করা উচিত। সম্ভব হলে ঘরের ভেতর ইলেকট্রিক ভোপোরাইজার বা মশা নিরোধক ক্রিম বা লোশন ব্যবহার করা উচিত। নিজেরা মশার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সিটি কর্পোরেশন বা সামাজিক সহায়তা নেওয়া প্রয়োজন।

কারও বাড়িতে যখন এক বা দুইজন মানুষ আক্রান্ত হয় তখন নিজের পরিবারকে রক্ষা করার জন্য সিটি কর্পোরেশনের দিকে তাকিয়ে না থেকে নিজ উদ্যোগে মশার প্রজনন স্থল ধ্বংস করা উচিত। সিটি কর্পোরেশনের দিকে তাকিয়ে থাকলে দক্ষিণখানের ওই বাড়ির মতো হয়তো ১৭ জন না হোক অনেক ব্যক্তিই আক্রান্ত হবে। তাই নিজ ও পরিবারের লোকজনের রক্ষায় নিজেদেরই সম্পৃক্ত হতে হবে।

হাসপাতালগুলোয় ডেঙ্গু রোগীর এত চাপ এবং প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিল প্রমাণ করে ছোট একটি পতঙ্গের কাছে আমরা পরাজিত। মনের মধ্যে কয়েকটি প্রশ্ন ঘুরপাক খায়, মশার কাছে আর কত পরাজয়? এই দায় কার?

সিটি কর্পোরেশনগুলো যেভাবে কার্যক্রম চালাচ্ছে তা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট নয় এর প্রমাণ আমরা দেখছি। ২০২৩ সালে বাংলাদেশের সব রেকর্ড ভেঙে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে ১ লাখ ৪৮ হাজার ৩২৮ জন আর দুর্ভাগ্যজনকভাবে মৃত্যু ৭৩০-এর বেশি (ঢাকা পোস্ট, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩)।

ছোট বড় বিভিন্ন ক্লিনিক ও হাসপাতাল এবং বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছে অসংখ্য রোগী। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গবেষকদের মতে ডেঙ্গু রোগী আরও কমপক্ষে ছয় গুণ বেশি।

হাসপাতালগুলোয় ডেঙ্গু রোগীর এত চাপ এবং প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিল প্রমাণ করে ছোট একটি পতঙ্গের কাছে আমরা পরাজিত। মনের মধ্যে কয়েকটি প্রশ্ন ঘুরপাক খায়, মশার কাছে আর কত পরাজয়? এই দায় কার? জনগণ, নগরবাসী, সরকার, সিটি কর্পোরেশন না স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়? গবেষক হিসেবে আমারও কি দায়ী নেই? এইসব ভেবে হতাশা গ্রাস করে আমায়।

দীর্ঘ সময় ধরে মশা নিয়েই কাজ করে যাচ্ছি। দিনরাত যতক্ষণ জেগে থাকি এটা নিয়েই ভাবি। সবসময় ল্যাবরেটরি ও মাঠ পর্যায়ে আমি ও আমার ছাত্ররা কাজ করে যাচ্ছে নিরলসভাবে। বাংলাদেশের এমন কোনো জায়গায় নেই যেখানে মশা নিয়ে কাজ করতে আমি যাইনি। এরপর যখন দেখি ডেঙ্গুতে শিশু মারা যাচ্ছে, প্রসূতি মারা যাচ্ছে তখন ভাবি, সব কি ইথারে যাচ্ছে? ভাবি, এভাবেই কি আমাদের পরাজয় ঘটবে?

ড. কবিরুল বাশার ।। অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
professorkabirul@gmail.com