
বাড়ি ছেড়েছি আজ থেকে ঠিক একবছর আগে। পূর্ণ হলো আমার নির্বাসনের এক বছর। ১বছর! কেউ কি কল্পনা করতে পারেন এই একবছর কতটা দূর্বিসহ?
আমাদের আশেপাশে এমন অনেক মানুষই আছে যারা তাদের পরিবারকে খুব অল্প সময়ে হারিয়ে ফেলে, সে কারনে অনেক দুঃখও পায়। চোখের জ্বলও ফেলে। আমিও এই একবছর আমার নির্বাসনের মাঝে হারিয়ে ফেলেছি আমার পরিবারকে। হারিয়েছি মায়ের আদর,স্নেহ,ভালোবাসা। হারিয়েছি বাবার কড়া শাসন, হারিয়েছি ছোট ভাইটির ভাইয়া ডাক, হারিয়েছি বোনের কাছ থেকে পাওয়া “ডাকাত” নামটিও, হারিয়েছি পিওর ভালোবাসাগুলো। হারিয়েছি পরিবারের ছোটছোট খুন-শুটি আনন্দগুলো। হারিয়েছি এলাকার মানুষজন,আত্বীয়-স্বজন ও প্রিয়দের স্বজনপ্রীতি…।
আমার এই বেদনার কথা বিশ্বের মানুষ হয়তো জানে না। তাই আমার জন্য কেউ কাদে না, চোখের জ্বল ফেলে না, দুঃখও করেনা। অচেনা-অজানা মানুষ হিসাবে তাই লিখতে হচ্ছে খাতায়, কথা বলতে হচ্ছে হাতের কলমের সঙ্গে। মাঝেমাঝে কলমের কিছু প্রশ্নে দিক হারিয়ে ফেলতেছি।
যাই হোক। পাটগ্রামের কথায় আসি, সেখানকার অনেকের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। তারা আমাকে খুব ভালো ভাবেই চিনেন-জানেন। আমিও তাদের শুভাকাঙ্ক্ষী হিসাবেই মানি। কিন্তু আমার বিরুদ্ধে যখন শহর,নগর এমনকি কলেজে মিছিল আরম্ভ হলো, তখন আমাকে আর কেউ আপন ভাবতে পারেনি। তখন আমার বিরুদ্ধে দু-চারটা কথা বলাই ছিল তাদের মুখপাত্র।
এদেশের মানুষ আর কাউকে না চিনলেও তসলিমা নাসরিনকে ঠিকই চিনে। আমি ঠিক সেরকমি একজন। ওনার মত লেখা লিখে করে মানুষের মনে কষ্ট দিয়ে থাকি। আর ভাগ্যক্রমে একখানা নামও পেলাম। -বিদঘুটে। পরিচিত অনেকে আরো অনেক নামে ডেকেছিল। এই যেমন; দেশদ্রোহী,উগ্রপন্থী নানান কিছু।
যাইহোক, অনেক তো নাম পেলাম, যা নয় তা শুনলাম, সময়ও ভালো যাচ্ছে। আমিও অপেক্ষায় করছি, কবে আমার নির্বাসন শেষ হবে, কবে আমি আমার পরিবারকে ফিরে পাবো। কিন্তু! কেউ কি আমাকে ফিরতে দিবে!
প্রায় সময় বাস্তবতা নিয়ে ফেসবুকে,ইন্সটাগ্রামে, কখনো পত্রিকায় ,হাতে কলমে কিছু সাদাসিদে কথা তুলে ধরি। যার জন্য অনেকের মনে হয়েছে আমার ভাষা খুব হিংসাত্মক। যা দেশের মানুষের জন্য ভয়ংকর!
আমার বেড়ে উঠা, ছেলেবেলা এসব নিয়ে লেখালেখি করা যদি হয় কোন দেশ বা জাতির জন্য অশ্লীল। তবে বাক স্বাধীনতা শব্দটা আজ প্রজ্জ্বোলিত।
একজন সাধারণত মানুষের মত প্রকাশের অধিকার যদি হয় এমন তবে তারা গণতান্ত্রিক শব্দটার ভাব-সম্প্রসারন জেনে নিবেন।
আজ নাৎসিরার কথা খুব মনে পড়ে। নাৎসিরা যখন বই পোড়াতো তখন কেউ আর বাধা দিতে পারতো না, তখন কেউ তার বিরুদ্ধে মামলা করবে এরকম বুকের পাটাও ছিল না কারো। কিন্তু আমি তো অগণতান্ত্রিক নই। কেন আমার বিরুদ্ধে ওরকমটা হবে?
আমার লেখালেখির অধিকার কেড়ে নিয়েছেন,বন্ধু-বান্ধব থেকে শুরু করে পরিবার পর্যন্ত মেলামেশা করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছেন। পাটগ্রামের মধ্যে হয়ত আমিই একজন। যাকে নিয়ে যা ইচ্ছা তাই করা যায়, যেভাবে ইচ্ছা সেভাবেই গল্পটা সাজানো যায়, যাকে অকারণে অপবাদ দেওয়া যায়, যাকে যত খুশি অসম্মান করা যায়, জঘন্য অপবাদ দেওয়া যায়। আমি নিশ্চিত আমার এই নির্বাসনে কেউ সামান্যটুকুও কষ্ট অনুভব করেনি,করেনা,করবেনা। আমার বেলায় দেশের বামপন্থীরাও মুহূর্তেই ডানপন্থী হয়ে যায়। আর আমি হয়ে যাই দেশদ্রোহী!
আমি এটাও জানি এই সিচুয়েশনে আমাকে কেউ আর স্বজনপ্রীতির কাছে আমাকে ফিরতে দিবেন না। ফিরতে না দিলেও সামান্যটুকুও আঁচড় পরবেনা এমন গ্যারান্টি দিতে পারে না।
তবে আমি তাদের আচরণে সামান্যটুকুও মন খারাপ করিনি, বরং ভালো লাগতো। ভাবতাম আমি বুঝি সেটাই হয়ে গেলাম। পরোক্ষণে আবার বুঝতে পেরে ভাবি, এরকম দিন আর থাকবে না, একদিন ঠিকই দিন আসবে, আমাকে মানুষজন চিনবে, জানবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত দু-চারজন ছাড়া আমাকে আর কেউ চিনলো না। বরং আমার নির্বাসন দিনে দিনে বেরেই চলল। এভাবে এক-পা,দু-পা করে নির্বাসন চলে যাবে মৃত্যু পর্যন্ত…।
-দীপু আহসান, (সাংবাদিক ও লেখক)।