মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মির সঙ্গে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর গোলাগুলির ঘটনা ঘটছে। এতে নতুন করে রোহিঙ্গা নাগরিকরা নৌকায় করে নাফ নদ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করছেন। তবে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে কঠোর অবস্থানে রয়েছে বিজিবি।
শুক্রবার রাত ১০টার দিকে টেকনাফের হোয়াইক্যং সীমান্তে নাফ নদীর ওপারে রাখাইন রাজ্যের কয়েকটি গ্রামে গোলাগুলি শুরু হয়। থেমে থেমে সেই গোলাগুলি শনিবার ভোর পর্যন্ত চলে। এতে আতঙ্ক হয়ে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছেন রোহিঙ্গারা।
সীমান্তের একাধিক সূত্র জানায়, গত কয়েকদিন ধরে নতুন করে আরাকান আর্মির অবস্থানে হামলা চালাচ্ছে দেশটির সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা), আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও), আরাকান রোহিঙ্গা আর্মিসহ (আরআইআর) কয়েকটি গোষ্ঠী। তাতে বেশ কিছু রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার চেষ্টা চালাচ্ছেন। কয়েক হাজার রোহিঙ্গা মংডুটাউনশিপের কাছাকাছি নাফ নদের তীরে অবস্থান করছেন। নাফ নদ অতিক্রম করে রোহিঙ্গারা টেকনাফে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছেন।
এর আগে ১৯ আগস্ট রাতে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে রাখাইন রাজ্যের ‘নারকেল বাগিচা’ এলাকায় সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে কয়েক ঘণ্টাব্যাপী গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। আরাকান আর্মির দখলে থাকা দুটি সীমান্তচৌকির দখলে নিতে অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠী এ হামলা চালায় বলে জানা গেছে।
টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের ২ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য সিরাজুল মোস্তফা চৌধুরী বলেন, ‘সীমান্তের ওপারে কুমিরখালী, শীলখালী ও সাইডং এলাকায় শুক্রবার রাত ১০টা থেকে শনিবার ভোর ৫টা পর্যন্ত টানা কয়েক ঘণ্টা গোলাগুলি চলেছে। তাতে নাফ নদে মাছ শিকারে যাওয়া বাংলাদেশি জেলে ও হোয়াইক্যং সীমান্ত জনপদের বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তবে ওপারের গুলি এপারে এসে পড়েনি। নাফ নদীতে বিজিবির টহল আছে। আজ কোনও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করার খবর পাইনি।’
সর্বশেষ শুক্রবার টেকনাফ বিজিবি নাফ নদে ৬২ জন রোহিঙ্গাকে প্রতিহত করেছে বলে জানিয়েছেন টেকনাফ-২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আশিকুর রহমান। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সীমান্তের ওপারে হাজারো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় আছে। তবে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে বিজিবি কঠোর অবস্থানে রয়েছে। কিছু লোক অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে। কিন্তু আমরা কাউকে ঢুকতে দিচ্ছি না। যেসব পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চলছে, সেখানে বিজিবির টহল বাড়ানো হয়েছে। পাশাপাশি গত রাতে সীমান্তের ওপার থেকে গোলাগুলির শব্দ আসার বিষয়টি জেনেছি। সেটি ওপারে। এতে আমাদের সীমান্তের বাসিন্দাদের আতঙ্কিত হওয়ার কোনও কারণ নেই।’
হোয়াইক্ষ্যং সীমান্তের বেড়িবাঁধের কাছাকাছি বাংলাদেশিদের বেশ কয়েকটি চিংড়ি ও কাঁকড়া চাষের ঘের রয়েছে। একটি চিংড়িঘেরে থাকেন হোয়াইক্ষ্যং এলাকার বাসিন্দা ও চিংড়ি ব্যবসায়ী আব্দুর রহমান। তিনি বলেন, ‘হোয়াইক্যং ইউনিয়নের বিপরীতে রাখাইন রাজ্যের কুমিরখালী, শীলখালী ও সাইডংসহ কয়েকটি গ্রাম রয়েছে। আট বছর আগেও এসব গ্রামে রোহিঙ্গা বসতি ছিল। মিয়ানমার জান্তা বাহিনী ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরের কয়েক মাসে লাখো রোহিঙ্গাকে বিতাড়িত করে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়। এরপর সেখানে গড়ে তোলা হয় সেনা ব্যারাক ও সীমান্তরক্ষীদের চৌকি। গত বছরের ৭ ডিসেম্বর জান্তা বাহিনীকে উচ্ছেদ করে সেনা ছাউনি ও ব্যারাকগুরো দখলে নেয় আরাকান আর্মি। এখন আরাকান আর্মির অবস্থানে হামলা চালাচ্ছে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী। শুক্রবার রাত থকে শনিবার ভোর পর্যন্ত কয়েক দফায় গোলাগুলির শব্দ শুনে পার্শ্ববর্তী বাজারে দৌড়ে আসি। সীমান্তের ওপার থেকে ফের যুদ্ধের মতো গোলার শব্দ ভেসে আসছে।’
রাখাইনে এখনও নির্যাতন বন্ধ হয়নি বলে জানালেন উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাঝি মো. হোসাইন। তিনি বলেন, ‘নির্যাতনের কারণে রোহিঙ্গাদের পালিয়ে আসা বন্ধ হচ্ছে না। প্রাণ বাঁচাতে তারা এপারে পালিয়ে আসার চেষ্টা করছেন। সীমান্তে অনেক রোহিঙ্গা জড়ো হয়েছেন বলে স্বজনদের কাছ থেকে খবর পেয়েছি।’
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ এহসান উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সীমান্তের ওপারে গোলাগুলির বিষয়টি স্থানীয়দের কাছ থেকে শুনেছি। আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সতর্ক অবস্থানে রয়েছে সীমান্তে। পাশাপাশি অনুপ্রবেশ ঠেকাতে শক্ত অবস্থানে রয়েছে বিজিবি-কোস্টগার্ড।’