রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) স্নাতক ও স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে ভর্তির ক্ষেত্রে বাতিলকৃত পোষ্য কোটা ১০টি শর্তসাপেক্ষে পুনর্বহাল করা হয়েছে। এ বিষয়ে গঠিত কমিটির সুপারিশক্রমে বৃহস্পতিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) বিকালে সিনেট ভবনে অনুষ্ঠিত ভর্তি কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এদিন সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দফতর থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিষয়টি জানানো হয়।
এদিকে, পোষ্য কোটা পুনর্বহালের প্রতিবাদে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করছেন শিক্ষার্থীরা। এদিন রাত সাড়ে ৭টায় এ কর্মসূচি পালন শুরু করেন ছাত্রদল, ছাত্রশিবিরসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মী ও শিক্ষার্থীরা। রাত ৯টায় এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কর্মসূচি চলছিল।
বিক্ষোভ সমাবেশে রাবি শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি এবং সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোট প্যানেলের ভিপি পদপ্রার্থী মোস্তাকুর রহমান জাহিদ বলেন, ‘এই ক্যাম্পাসে রাকসু বানচালকারী গোষ্ঠী খুবই তৎপর। তারা বানচালে তৎপর না হলে ৩৫ বছর ধরে রাকসু নির্বাচন বন্ধ থাকতো না। এখন যখন দেখছে রাকসু নির্বাচন হয়েই যাচ্ছে, তখন তারা মীমাংসিত একটা ইস্যুকে সামনে নিয়ে আনছে। আমাদের সাবধান থাকতে হবে, পোষ্য কোটা একবার নিপাত গিয়েছে। এটাকে আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। আর রাকসু নির্বাচন ২৫ সেপ্টেম্বরেই হতে হবে।’
রাবি শাখা ছাত্রদলের দফতর সম্পাদক এবং ছাত্রদল সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ নতুন প্রজন্ম প্যানেলের জিএস পদপ্রার্থী নাফিউল ইসলাম জীবন বলেন, ‘রাকসু নির্বাচনকে সামনে রেখে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যে ধরনের নোংরামি করছে, আমরা তীব্র নিন্দা জানাই। আমরা এই পোষ্য কোটার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছি। অবিলম্বে এই কোটা বাতিল করতে হবে।’
সমাজকর্ম বিভাগের শিক্ষার্থী ও রাকসুর এজিএস পদপ্রার্থী জান্নাত-আরা নওশিন বলেন, ‘মৃত মানুষ কবর থেকে ফিরে আসে না, তাহলে কবরে দাফনকৃত পোষ্য কোটা কীভাবে ফিরে আসে। রাবি প্রশাসন আমাদের রক্তের ওপর দিয়ে চেয়ারে বসেছে, তারা কীভাবে রক্তের ওপর দিয়ে এ সিদ্ধান্ত নেন। যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের শরীরে একবিন্দু রক্ত থাকবে, ততক্ষণ আমরা এই কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যাবো।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দফতর থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে ১০টি শর্তসাপেক্ষে পোষ্য কোটা পুনর্বহাল করা হয়েছে। শর্তগুলো হলো- কেবলমাত্র রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সন্তান এই ভর্তির সুযোগ পাবে। ভর্তির প্রাথমিক আবেদনের জন্য বিজ্ঞাপিত যোগ্যতা এবং শর্ত এক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে, মেধার ভিত্তিতে ভর্তির জন্য নির্ধারিত আসনসংখ্যার অতিরিক্ত হিসেবে এ প্রক্রিয়ায় ভর্তির বিষয়টি বিবেচনা করা হবে, ভর্তির ক্ষেত্রে প্রাপ্ত নম্বর বিবেচনা করে মেধা অনুসরণ করা হবে, ভর্তির আবেদন বিবেচনার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিভাগের নির্ধারিত শর্তাবলীসহ অবশ্যই ন্যূনতম পাস নম্বর থাকতে হবে।
শর্তগুলোর মধ্যে আরও রয়েছে, কোনও বিভাগে দুজনের অধিক ভর্তির সুযোগ থাকবে না, কোনও শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীর সন্তানকে তার কর্মরত বিভাগে ভর্তি করানো যাবে না, এ সুবিধার আওতায় নিজেদের মধ্যে ‘অটো মাইগ্রেশন’ ছাড়া শিক্ষার্থীর বিভাগ পরিবর্তনের অন্য সুযোগ থাকবে না, ভর্তির ক্ষেত্রে এবং পরবর্তীতে কোনও অভিভাবকের অনিয়মের আশ্রয় নেওয়ার বিষয় প্রমাণিত হলে ছাত্রত্ব বাতিলসহ সংশ্লিষ্ট অভিভাবকের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত শৃঙ্খলাবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে মর্মে অঙ্গীকারনামায় উল্লেখ করতে হবে এবং এ সুবিধার আওতায় ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থী কোনোভাবেই আবাসিক হলে সিটের জন্য আবেদন করার সুযোগ পাবে না।
পোষ্য কোটা পুনর্বহালের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘদিন যাবত প্রচলিত কর্মরত শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীর পুত্র-কন্যাদের ভর্তির প্রক্রিয়াকে শিক্ষার্থীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বৈষম্যমূলক ও জুলাই-আগস্ট বিপ্লব পরবর্তী চেতনার পরিপন্থি বলে উল্লেখ করে তা বাতিলের দাবি জানায়। তারা এও জানায় যে, অতীতে ভর্তি পরীক্ষায় ন্যূনতম পাস নম্বর না পাওয়া সত্ত্বেও ভর্তির নজির আছে, যা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে ভর্তির ধারাকে ক্ষুণ্ন করে। এ ছাড়া কিছু ক্ষেত্রে অভিভাবকের বিভাগে ভর্তি হয়ে পুত্র-কন্যারা বিশেষ সুবিধা ভোগ করে বলেও তারা অভিযোগ করে।
বিপরীতে, পুত্র-কন্যাদের ‘প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা’ হিসেবে ভর্তির সুযোগের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ক্রমাগত দাবি জানিয়ে আসছেন। তারা আরও বলে যে, দীর্ঘদিনের প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত এই সুবিধা আকষ্মিকভাবে বন্ধ করা অত্যন্ত অযৌক্তিক ও অসমিচীন। শিক্ষার্থীদের দাবি আদায়ের কর্মসূচি সম্পর্কে তারা বলেন, গত ২ জানুয়ারি শিক্ষার্থীরা প্রশাসন ভবনে দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড-চলাকালে তালাবদ্ধ করে।
এ সময় তারা কোনও খাবারও প্রবেশ করতে দেয়নি। উপ-উপাচার্যদ্বয়, কোষাধ্যক্ষ, শিক্ষক, কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সেবা গ্রহণে আগত ব্যক্তিবর্গ প্রায় ১৩ ঘণ্টা প্রশাসন ভবন-১ এ অবরুদ্ধ হয়ে থাকেন। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা কর্তৃপক্ষকে কোনও প্রকার আলাপ-আলোচনা এবং তাদের দাবির যৌক্তিকতা বিবেচনার সুযোগ না দিয়েই সে দাবি মেনে নিতে বাধ্য করে। একই সময়ে জাহাঙ্গীনগর এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের সুবিধা বাতিল/স্থগিত করলেও পরবর্তীতে যথাসময়ে তারা এটিকে পরিমার্জিত রূপে পুনর্বহাল করে।
আগে থেকে যেসব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের সুবিধা প্রচলিত ছিল তার কোনোটিই বন্ধ করা হয়নি। শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ আরও উল্লেখ করেন যে, অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে এ সুবিধা বিদ্যমান থাকা অবস্থায় শুধুমাত্র রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তা বন্ধ করাও এক ধরনের বৈষম্য। সম্প্রতি ২০২৫-২০২৬ শিক্ষাবর্ষে একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ভর্তিতে সরকারি স্কুল-কলেজ ও শিক্ষা অফিসে কর্মরত শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সন্তানদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ও বিভাগীয় সুবিধা হিসেবে সরকার ইকিউ কোটা (এডুকেশন কোটা) চালু করেছে। এ থেকে বিষয়টি সম্পর্কে সরকারের একটা নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়।
শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ এ সুবিধাকে চালু রাখার জন্য ক্রমাগত দাবি জানাতে থাকেন। এর অংশ হিসেবে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মবিরতি পালন করে আসছেন। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এ ধরনের সুবিধা প্রদানের বিরোধিতা করে বক্তৃতা-বিবৃতি ও সমাবেশ করছে। ফলে এক অনাকাঙ্ক্ষিত অনভিপ্রেত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তবে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি নিষ্পত্তির প্রতি আগ্রহ ব্যক্ত করে।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পৃথকভাবে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে বারবার আলোচনা করে বিরাজমান পরিস্থিতি নিরসনে মতামত ও পরামর্শ গ্রহণ করে। এ ছাড়া উপর্যুক্ত বিষয়ের সুষ্ঠু সমাধানের নিমিত্তে উপ-উপাচার্য (প্রশাসন)-এর সভাপতিত্বে ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পুত্র-কন্যা ভর্তিতে প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা প্রদানের বিষয়ে গঠিত কমিটি’ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচলিত প্রাসঙ্গিক প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে তা পর্যালোচনা করেছে।
আলোচনায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের দাবির পাশাপাশি শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দাবি বিবেচনা করে যেসব বিষয় উঠে এসেছে, তার অন্যতম হলো দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ‘প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা’ হিসেবে কিছু সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে থাকে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দ যেহেতু অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ডে নিবেদিতভাবে দায়িত্ব পালন করেন, সেহেতু সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গঠিত কমিটি শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীর পুত্র-কন্যাদের প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধার আওতায় ভর্তির সুযোগ দেওয়ার বিষয়টি শর্তসাপেক্ষে বিবেচনার জন্য সুপারিশ করে।