বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের পরিচয়ধারী ১২৩ জন ‘চাঁদাবাজের’ নাম সংবলিত একটি কথিত তালিকা রাজশাহীর রাজনৈতিক অঙ্গনে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। এই তালিকায় বিএনপি, ছাত্রদল ও তাদের সহযোগী সংগঠনের ৪৪ নেতাকর্মী, ক্যাডার, সমর্থকের নাম পরিচয় রয়েছে। আওয়ামী লীগের ২৫ জন ও জামায়াতের ছয় জনের নাম রয়েছে। তবে বাকিগুলোর নাম ঠিকানা থাকলেও নেই রাজনৈতিক পরিচয়। তাদের বলা হয়েছে ‘সুবিধাবাদী’।
প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে তালিকাটি হোয়াটসঅ্যাপে ছড়িয়ে পড়েছে। হাতে এসেছে গণমাধ্যমকর্মীদেরও। এটি নিয়ে ভেতরে-ভেতরে আলোচনা চললেও নগরউর বোয়ালিয়া থানায় একটি চাঁদাবাজির মামলা হওয়ার পর তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে।
তবে পুলিশ বলছে, ‘এ তালিকা তারা করেনি। তবে তালিকার বিষয়ে তারা গণমাধ্যম কর্মীদের থেকে শুনেছেন।’ এই তালিকা পুলিশের নাকি সরকারের অন্যকোনও সংস্থার তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
সম্প্রতি রাজশাহীর একজন আবাসন ব্যবসায়ীর দায়ের করা চাঁদাবাজির মামলায় এই তালিকার ১৮ জনের নাম রয়েছে। সেই মামলায় ছাত্রদল ও যুবদলের নেতাদের প্রধান আসামি করা হয়েছে। এই মামলার প্রতিবাদে তারা নগর বিএনপির দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন ছাড়াও নগরীর সাহেববাজারে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে।
তালিকায় দেখা গেছে, বোয়ালিয়া থানা এলাকায় ২২, রাজপাড়া থানা এলাকায় ১৮, চনিন্দ্রমা থানা এলাকায় ১২, মতিহার থানা এলাকায় ৭, শাহ মখদুম থানা এলাকায় ২০, এয়ারপোর্ট থানা এলাকায় ১০, পবা থানা এলাকায় ৮, কর্নহার থানা এলাকায় ২০ এবং কাশিয়াডাঙ্গা থানা এলাকার ৬ জনের নাম রয়েছে।
এই তালিকার এক নম্বরে নাম রয়েছে পটু বাবু। তিনি ৭ জুলাই গ্রেফতার হয়েছেন। ২ নম্বরে নাম আছে ককটেল মুরাদ। তিনি গ্রেফতার হয়েছেন ২১ জুলাই। পটু বাবুর বিষয়ে লেখা রয়েছে, ‘তিনি গাঁজা ফেন্সি বিক্রেতা ও ছিনতাই চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপকর্মের সঙ্গে জড়িত। জিরো পয়েন্ট বড় মসজিদের দক্ষিণ পাশে মসজিদ মিশন স্কুলের আশপাশে বিভিন্ন দোকানে পণ্য সরবরাহকারী কাভার্ডভ্যান গাড়ি থেকে তিনি চাঁদাবাজি করেন। তিনি ভুয়া সাংবাদিকের কার্ড করে নিজেকে সাংবাদিক বলে পরিচয় দেন। বর্তমানে সক্রিয়।’
গ্রেফতার ককটেল মুরাদের বিষয়ে লেখা হয়, ‘তিনি গাঁজা বিক্রেতা ও ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপকর্মের সঙ্গে জড়িত। জিরোপয়েন্ট বড় মসজিদ এলাকায় চাঁদাবাজি করেন। তার বিভিন্ন অপকর্মে ও অত্যাচারে এলাকার মানুষ অতিষ্ঠ বলে জানা যায়।’
গত বুধবার (২৩ জুলাই) মোস্তাফিজুর রহমান নামের এক ডেভেলপার ব্যবসায়ী দুই লাখ টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগে নগরের বোয়ালিয়া থানায় একটি মামলা করেন।
এ মামলায় ৩৬ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৮ জনেরই নাম রয়েছে ছড়িয়ে পড়া ‘চাঁদাবাজদের’ কথিত ওই তালিকায়। ইতিমধ্যে গ্রেফতার হওয়া পটু বাবু ও ককটেল মুরাদও এ মামলার আসামি।
এই তালিকায় মহানগর বিএনপির একজন যুগ্ম আহ্বায়ক সম্পর্কে বলা হয়েছে, ৫ আগস্টের পর থেকে মামলার ভয়ভীতি দেখিয়ে চাঁদাবাজি করছেন। মহানগর বিএনপির এক সদস্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, নগরীর বোয়ালিয়া থানাধীন ফুটপাত থেকে চাঁদাবাজি করেন তিনি।
ছাত্রদলের এক নেতা সম্পর্কে বলা হয়েছে, ৫ আগস্টের পর থেকে আওয়ামী লীগের অনুসারীদের মামলার ভয়ভীতি ও বিভিন্ন কোচিং সেন্টার থেকে চাঁদাবাজি করেছেন তিনি।
জামায়াতের একজনকে ‘ক্যাডার’র সম্পর্কে বলা হয়েছে, ভূমি দখল ও কেনাবেচা, বিভিন্ন গণমাধ্যম ব্যক্তিদের হুমকি-ধমকি ও বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে বাধা দিয়ে চাঁদা আদায় করেন তিনি। জামায়াতের আরও যাদের নাম দেওয়া হয়েছে, তাদের সবার নামে প্রায় একই ধরনের অভিযোগ তোলা হয়েছে। আর একজনের বিরুদ্ধে মাদক কারবারির অভিযোগ তোলা হয়েছে।
এ বিষয়ে রাজশাহী মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ আলী ঈশা বলেন, ‘তালিকার কথা শুনেছি। তবে দেখিনি। যদি প্রশাসন বিষয়টি না জানে। তাহলে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কেউ এই তালিকা ছেড়েছে।’
এ বিষয়ে রাজশাহী মহানগর জামায়াতের সেক্রেটারি এমাজ উদ্দিন মণ্ডলের মোবাইল ফোনে কয়েকবার কল করা হলে তিনি কেটে দেন। তাই এ বিষয়ে তার কোনও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে অন্য গণমাধ্যমে দেওয়া বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘যাদের নাম তালিকায় আছে, তাদের সংগঠন থেকে সম্পূর্ণ বয়কট করা হয়েছে। নেতাদেরও বলে দেওয়া হয়েছে কারও কাছে যেন তারা ঘেঁষতে না পারেন।’
রাজশাহী মহানগর পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত উপ কমিশনার গাজিউর রহমান বলেন, ‘যে তালিকার কথা বলছেন, সেটা আমি জানি না। তবে বিভিন্ন সময়ে সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের তালিকা করা হয়। এটা শুধু পুলিশ করে না, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা আছে। তারা এই তালিকা করে পুলিশকে দেয়। পুলিশ ভেরিফাই করে। কারণ, অ্যাকশন নেওয়ার দায়িত্ব তো পুলিশের। বিভিন্ন হাত ঘুরেই তালিকাগুলো করা হয়। পুলিশ ভেরিফাই করে এটা সঠিক আছে কি না। এইটা সেই রকম তালিকা কি না সেটা আমার জানা নাই। তবে তালিকায় থাকা ব্যক্তিরা যদি সত্যিই চাঁদাবাজ হয়ে থাকে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। মানুষকে তো স্বস্তিতে রাখতে হবে। চাঁদাবাজরা সে যেই দলেরই হোক, দলীয় পরিচয় যা-ই হোক, তার পরিচয় মানুষের কাছে চাঁদাবাজ। যারা চিহ্নিত চাঁদাবাজ তারা ছাড় পাবে না।’