নিজস্ব প্রতিবেদক,খুলনা
খুলনা এখন ধীরে ধীরে পরিণত হচ্ছে “খুনের নগরী”। প্রতিদিন কোথাও না কোথাও ঘটছে হত্যাকাণ্ড, লাশ উদ্ধার বা সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা। শহর থেকে শুরু করে উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত—নিত্যদিনের সহিংসতা খুলনাবাসীর জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রশাসনের চোখের সামনেই এসব নৃশংসতা ঘটছে, অথচ আইনি পদক্ষেপ সীমিত পর্যায়ে রয়ে গেছে।
প্রতিদিন নতুন লাশ, আতঙ্কে সাধারণ মানুষ
গত এক সপ্তাহে খুলনার বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ছয়জন নিহত হয়েছে। কোনো কোনো দিনে একাধিক লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। খুলনা রেলস্টেশন, রূপসা, ফুলতলা ও দিঘলিয়া উপজেলায় ধারাবাহিকভাবে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
রূপসা উপজেলার রাজাপুর এলাকায় ড্রাগ চক্রের দুই দলের বন্দুক-যুদ্ধে নিহত হয়েছে দু’জন—সাব্বির শেখ ও সাদ্দাম। পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনাস্থল থেকে গুলির খোসা ও দেশি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। সংঘর্ষে মিরাজ নামে একজন গুরুতর আহত হন, পরে তিনি হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যান।
ফুলতলা উপজেলার মধ্যডাঙ্গা গ্রামে ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ফরুক মোল্লা (৪৮) কে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ধারালো অস্ত্র দিয়ে দুই পায়ের টেন্ডন কেটে দেওয়া হয়। এলাকাবাসী অভিযোগ করেছেন, এই হত্যার পেছনে দীর্ঘদিনের আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদাবাজি বিরোধ রয়েছে।
ছাত্র ও রাজনৈতিক কর্মীও নিরাপদ নয়
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অর্ণব কুমার সরকার (২৬) কে তেতুলতলা এলাকায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, দুই মোটরসাইকেল আরোহী হেলমেট পরে এসে তাকে গুলি করে দ্রুত পালিয়ে যায়।
দৌলতপুর থানার মহেস্বরপাশা পশ্চিমপাড়ায় যুবদল নেতা মাহবুবুর রহমান (৪০) নিজ বাড়ির সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। পরিবারের দাবি, রাজনৈতিক বিরোধের জেরে পরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা করা হয়েছে।
পারিবারিক ও ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বেও ঝরছে রক্ত
সোনাডাঙ্গা মডেল থানার বাঁশতলা এলাকায় এক ব্যক্তি নিজের ছেলে ও পুত্রবধূর হাতে খুন হয়েছেন। পুলিশ জানিয়েছে, পারিবারিক কলহ ও অর্থ নিয়ে বিরোধের জেরে ছেলেরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাকে হত্যা করেছে। পুলিশ এই ঘটনায় দু’জনকে গ্রেপ্তার করেছে।
গত কয়েক দিনে খুলনা শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে আরও অজ্ঞাত তিনটি লাশ উদ্ধার হয়েছে। এর মধ্যে একটি লাশের হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পাওয়া যায় এবং আরেকটি পচা অবস্থায়। ময়নাতদন্তে দেখা গেছে, অধিকাংশই ধারালো অস্ত্রের আঘাতে নিহত।
বাড়ছে গ্যাং কালচার ও চাঁদাবাজি
রূপসা, লবণচরা, বটিয়াঘাটা ও তেরখাদা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় গ্যাং কালচার ও ড্রাগ সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সংঘর্ষ নিয়মিত ঘটছে। “বি কোম্পানি” ও “চাঁদা মানিক” গ্রুপের মধ্যে আধিপত্যের লড়াইয়ে রূপসা এলাকায় প্রায়ই গুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটে।
গত মাসে অজ্ঞাত হামলাকারীদের গুলিতে নিহত হন ইমরান হোসেন মানিক, যিনি স্থানীয়ভাবে “চাঁদা মানিক” নামে পরিচিত ছিলেন।
প্রশাসনের অবস্থান
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার এক বিবৃতিতে জানান, গত ১০ মাসে খুলনা জেলায় অন্তত ২৬টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এর মধ্যে ২৪টি মামলার তদন্ত চলছে এবং বেশ কয়েকজন আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে। তবে অনেক হত্যাকাণ্ডের মূল রহস্য এখনো উদঘাটিত হয়নি।
পুলিশের বক্তব্য:
“খুনের পেছনে রয়েছে ব্যক্তিগত শত্রুতা, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও মাদক ব্যবসার ভাগাভাগি। আমরা চেষ্টা করছি দ্রুত অপরাধীদের গ্রেপ্তার করতে।”
স্থানীয়রা অভিযোগ করছেন, খুন ও লাশ উদ্ধারের ধারাবাহিকতায় প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ছে। এক ব্যবসায়ী বলেন,
“সবাই জানে, কে করছে, কিন্তু কেউ মুখ খুলছে না।”
সামাজিক বিশ্লেষণ
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, খুলনায় অপরাধ এখন সংগঠিত রূপ নিয়েছে। সামাজিক ও প্রশাসনিক অনিয়ম, আইনি জটিলতা ও দোষীদের দ্রুত শাস্তি না হওয়ায় অপরাধীরা সাহস পাচ্ছে।
সাধারণ মানুষের দাবি:
-
রাস্তায় পুলিশি টহল বাড়ানো
-
সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো
-
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জবাবদিহি নিশ্চিত করা
পরিশেষে
প্রতিদিন লাশ পাওয়া, গুলির শব্দ শোনা বা হামলার খবর এখন খুলনার মানুষের নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠেছে। কেউ বলছেন,
“রাতে বের হওয়া মানে জীবনের ঝুঁকি নেওয়া।”
অপরাধ নিয়ন্ত্রণে দৃশ্যমান অগ্রগতি না এলে, খুলনা খুব দ্রুতই “খুনের নগরী” নামেই পরিচিত হয়ে যাবে—এমন শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সমাজকর্মীরা।












