একসময় যাদের ক্ষেপণাস্ত্রকে তাচ্ছিল্য করত পশ্চিমা বিশ্ব, সেই ইরানেরই এখনকার হামলা ইসরাইলকে ভীষণভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে। বলিষ্ঠতার জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র শক্তি। এখন আর লক্ষ্যভ্রষ্ট হচ্ছে না সেসব অস্ত্র। ২০২৩ সালের অক্টোবরে আল আকসা ঝড় (আল আকসা স্টর্ম) অভিযানের সূচনা থেকে শুরু হওয়া পাল্টা লড়াই এখন ১৭তম দফায় গড়িয়েছে। আর ইসরাইল এখন বাধ্য হয়ে স্বীকার করছে, ইরান তাদের ক্ষেপণাস্ত্র আঘাতের নিখুঁততা তিনগুণ বাড়িয়ে ফেলেছে।
গত ১৩ জুন ইসরাইল কোনোরকম উসকানি ছাড়াই ইরানের ভেতরে পারমাণবিক, সামরিক ও আবাসিক এলাকায় ব্যাপক বিমান হামলা চালায়। এতে শহীদ হন অনেক শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা, পরমাণু বিজ্ঞানী এবং সাধারণ মানুষ। এর জবাবে ইরান শুরু করে ‘অপারেশন ট্রু প্রমিস থ্রি’। ইসলামী বিপ্লবী রক্ষীবাহিনী বা আইআরজিসি ২০ জুন জানায়, এই অভিযানের অংশ হিসেবে তারা ১৭তম ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে দখলদার ইহুদিবাদী ইসরাইলের বিভিন্ন সামরিক ঘাঁটি ও কৌশলগত স্থাপনায়।
আইআরজিসি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ইরানি হামলার লক্ষ্য ছিল নেভাতিম ও হাতজেরিম বিমান ঘাঁটি, সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদন কেন্দ্র, কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টার এবং ইসরাইলি বাহিনীকে রসদ সরবরাহকারী বিভিন্ন কোম্পানি। তেল আবিব, হাইফা ও বেরশেভা শহরে ইরান নিখুঁত আঘাত করে। এসব আঘাতে ভয়াবহ বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে উঠেছিল গোটা অঞ্চল। দেখিয়ে দিয়েছে, ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের আক্রমণ ক্ষমতা এখন আগের চেয়ে বহুগুণ বেশি।
যুদ্ধ মানে কেবল গোলাবর্ষণ নয়, কার কৌশল কত নিখুঁত, সেটা ও ঠিক করে দেয় ফলাফল। আর সেই মানদণ্ডে ইরান এখন শক্ত প্রতিপক্ষ। ইসরাইলি সামরিক কর্তারা গণমাধ্যমের কাছে স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছেন, ইরানের সাম্প্রতিক হামলাগুলোর ‘হিটরেট’ বা লক্ষ্যভেদী সফলতা আগের তুলনায় তিনগুণ বেড়েছে। যেখানে একসময় একাধিক ক্ষেপণাস্ত্র ও লক্ষ্যভ্রষ্ট হতো, এখন প্রায় প্রতিটি ক্ষেপণাস্ত্রই লক্ষ্যে আঘাত হানছে। সাম্প্রতিক এক হামলায় কেবল একটি ক্ষেপণাস্ত্র ইসরাইলের উন্নত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিয়ে সরাসরি ঢুকে পড়েছে এক গোপন সামরিক-নিরাপত্তাকেন্দ্রে।
এই স্বীকারোক্তি এসেছে ইসরাইলি সেনাবাহিনীর উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাছ থেকেই। এর ফলে ইসরাইলের আগের দাবি যে তারা ইরানের ৯০ শতাংশ ক্ষেপণাস্ত্রগুলো প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছে তা এখন হাস্যকর হয়ে উঠেছে।
ইসরাইল এখন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাধুনিক এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম যেমন ‘আয়রনডোম’, ‘ডেভিডস স্লিং’ ও ‘অ্যারো’ ব্যবহার করছে। কিন্তু এই প্রযুক্তি ও সহায়তাও ইরানের নতুন প্রজন্মের ক্ষেপণাস্ত্র থামাতে পারছে না। ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর উচ্চগতিশীলতা, পথচ্যুতি এড়ানোর ক্ষমতা আর নিখুঁত লক্ষ্যবস্তুর দিকে এগিয়ে যাওয়ার কৌশল এখন এই প্রতিরক্ষাব্যবস্থার জন্য এক অজেয় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শুক্রবারের ক্রোধ ও বিজয় বা ‘রথ অ্যান্ড ভিক্টরি’ প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে ইরানের সাধারণ মানুষ দেখিয়ে দিয়েছেন, এই প্রতিরোধ শুধু সামরিক নয়, এটি একটি গণআন্দোলনও বটে। বিদেশে বসবাসরত ইরানিরাও সমর্থন জানিয়েছেন এই হামলার। বিভিন্ন ‘মুক্তচিন্তার জাতি’ ও ‘প্রতিরোধ আন্দোলন’ থেকেও এসেছে বার্তা- এই লড়াই ইসরাইলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একটি বৈধ প্রতিরোধ।
ইরান আর আগের সেই ইরান নেই- যাকে বারবার অবরোধ দিয়ে থামিয়ে রাখা যেত। এখনকার ইরান নিজেদের প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি করছে এমন সব অস্ত্র, যা পাশ্চাত্যের সামরিক দাপটকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেছে। ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের সফলতা শুধু প্রতিশোধই নয়, এটি ভবিষ্যতের যুদ্ধনীতি বদলে দিচ্ছে। ইসরাইলের জন্য এটি নিছক একটি নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ নয়, বরং তার কৌশলগত ভারসাম্যের পতনের শুরু হতে পারে।
‘প্রমিস থ্রি’ এখন আর কেবল একটি সামরিক অপারেশন নয়- এটি হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক বার্তা, প্রতিরোধের প্রতীক। ইরান বলছে, যতদিন না পর্যন্ত ইহুদিবাদী আগ্রাসনের পূর্ণ শাস্তি হয়, এই হামলা চলবে। আর ইসরাইল চুপচাপ স্বীকার করে নিচ্ছে- মাঠের হিসাব পাল্টে গেছে।
ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র আর নিছক অস্ত্র নয়, তা এখন একধরনের কূটনৈতিক ভাষাও। মধ্যপ্রাচ্যের বাতাসে তাই শুধু ধোঁয়া নয়- আছে নতুন ভূরাজনীতির গন্ধ। ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র এখন আর পথ হারায় না, বরং ইতিহাসের পথ তৈরি করে।