কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী সুমাইয়া আফরিন এবং তার মা তাহমিনা বেগমকে হত্যার ঘটনায় সিসিটিভি ফুটেজ দেখে একজনকে সন্দেহ করছে র্যাব ও পুলিশ। তাদের ধারণা, ওই ব্যক্তিই মা ও মেয়েকে হত্যা করে থাকতে পারেন। এ ছাড়া ওই বাড়ি থেকে কিছু আলামত জব্দ করেছে তারা।
এরই মধ্যে সোমবার (০৮ সেপ্টেম্বর) দুপুরে হত্যার ঘটনায় একজনকে আটক করেছে র্যাব। র্যাবের ভাষ্য, সন্দেহভাজন হিসেবে আটক হওয়া ওই ব্যক্তি একজন কবিরাজ। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। প্রাথমিক তদন্তের পর পুলিশ বলছে, এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে তাই মনে হচ্ছে তাদের।
সোমবার সকাল ৭টার দিকে নগরের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কালিয়াজুরী এলাকার পিটিআই মাঠসংলগ্ন নেলী কটেজ নামের একটি ভবনের দোতলা থেকে মা ও মেয়ের লাশ উদ্ধার করা হয়। তারা হলেন- কুমিল্লা নগরের ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের সুজানগর এলাকার মৃত নুরুল ইসলামের স্ত্রী তাহমিনা বেগম (৫২) ও তার মেয়ে সুমাইয়া আফরিন (২৩)। নুরুল ইসলাম কুমিল্লা আদালতের কর্মকর্তা ছিলেন। গত বছরের ১৯ অক্টোবর মারা যান। এই ভাড়া বাসায় প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে থাকছেন তারা। সুমাইয়া আফরিন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তাহমিনা বেগমের দুই ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে বড় ছেলে মো. তাজুল ইসলাম ওরফে ফয়সাল আইনজীবী, তিনি ঢাকায় থাকেন। ছোট ছেলে সাইফুল ইসলাম আল আমিন কুমিল্লা ইপিজেডে চাকরি করেন। সাইফুল রবিবার ছিলেন ঢাকায়। ঢাকা থেকে রবিবার রাতে কাছাকাছি সময়ে দুই ভাই কুমিল্লায় ফেরেন। প্রথমে রাত ১০টা ৪৫ মিনিটে বাসায় প্রবেশ করেন বড় ছেলে তাজুল ও এর কিছুক্ষণ পরেই বাসায় আসেন ছোট ছেলে সাইফুল।
এলাকাবাসী ও পুলিশ জানায়, নেলী কটেজের ওই ভবনের নিচতলায় ‘হাতেখড়ি আনন্দ পাঠশালা’ নামে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। ভবনের নিচতলায় থাকা ওই প্রতিষ্ঠানের সিসিটিভি ফুটেজে মাথায় টুপি, পাঞ্জাবি-পাজামা পরা এক ব্যক্তির সন্দেহজনক যাতায়াত ধরা পড়েছে। ফুটেজে দেখা যায়, রবিবার সকাল ৮টা ৮ মিনিটে ওই ব্যক্তি নেলী কটেজে প্রবেশ করেন। বেলা ১১টা ২২ মিনিটে ওই ব্যক্তিকে বের হতে দেখা যায়। তবে ১২ মিনিট পরই আবার ওই ব্যক্তিকে ভবনে প্রবেশ করেন। তবে এবার হাতে দুটি ব্যাগসহ প্রবেশ করেন। এরপর দুপুর ১টা ৩৫ মিনিট পর্যন্ত তাকে ওই বাসা থেকে বের হতে দেখা যায়নি। এরপর স্কুল বন্ধ হয়ে গেলে সিসিটিভি ক্যামেরাও বন্ধ হয়ে যায়। প্রতিদিন দুপুরে ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটির পর সিসি ক্যামেরা বন্ধ করে রাখা হয়। এজন্য পরবর্তী সময়ে ওই ব্যক্তি কখন বের হয়েছেন, সেটি ক্যামেরায় ধরা পড়েনি। ফুটেজে দেখে ওই ব্যক্তিকে ৪০-৪৫ বছর বয়সী বলে মনে হচ্ছে পুলিশের।
সিসিটিভি ফুটেজের বিষয়ে হাতেখড়ি আনন্দ পাঠশালার সভাপতি আবু জাহেদ বলেন, ‘একজন পাঞ্জাবি পরা ব্যক্তিকে বেশ কয়েকবার ওই বাসায় ঢুকতে দেখা গেছে ফুটেজে। পরের বার যখন ঢুকেছেন তখন পোশাকে পরিবর্তন ছিল। তবে পুলিশ বলছে দুজন একই ব্যক্তি। প্রতিদিন স্কুল ছুটি হলে দুপুরে সিসিটিভি ক্যামেরা বন্ধ করে রাখা হয়। বন্ধ করার আগপর্যন্ত লোকটি বাসার মধ্যেই ছিল বলে ধারণা করছি আমরা। এরপর হয়তো কোনও একসময়ে বের হয়ে গেছেন। এর আগে ওই ব্যক্তিকে স্কুলে কিংবা এই এলাকায় দেখিনি আমরা।’
নেলী কটেজের মালিক আনিছুল ইসলাম বলেন, ‘রাতে নিহত ব্যক্তির ছেলে সাইফুল ইসলাম আমাকে কল করে জানান তার মা ও বোনকে কেউ হত্যা করে ফেলে রেখে গেছে। আমি তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি দুটি আলাদা কক্ষে মা ও মেয়ের লাশ পড়ে আছে, পরে পুলিশ আসে। প্রায় সাড়ে তিন বছর আগে ওই বাসা ভাড়া নিয়েছিলেন কুমিল্লা আদালতের পেশকার নুরুল ইসলাম। গত বছর তার মৃত্যুর পর স্ত্রী তাহমিনা বেগম সন্তানদের নিয়ে সেখানে বসবাস করছিলেন। পরিবারটি খুবই শান্ত ছিল। তারা এখানে দীর্ঘদিন ভাড়া থাকলেও অন্য কারও সঙ্গে তেমন কথাবার্তা বলতেন না। আমরা এ ঘটনার সঠিক তদন্ত ও বিচার চাই।’
এরই মধ্যে নিহত তাহমিনার সঙ্গে সর্বশেষ যোগাযোগের সূত্র ধরে দুপুর ২টার দিকে একজনকে কুমিল্লার নাঙ্গলকোট থেকে আটক করেছে র্যাব। আটক ওই ব্যক্তির নাম আবদুর রব (৭৩)। তিনি নাঙ্গলকোট উপজেলার বাসিন্দা এবং পেশায় কবিরাজ।
র্যাব-১১ সিপিসি-২ কুমিল্লার কোম্পানি অধিনায়ক মেজর সাদমান ইবনে আলম বলেন, ‘সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে নাঙ্গলকোট উপজেলা থেকে আবদুর রবকে সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করা হয়েছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হওয়া গেছে আবদুর রবের সঙ্গেই সর্বশেষ কথা হয়েছে নিহত ব্যক্তিদের। ওই বাসায় তার যাওয়া-আসা ছিল। আবদুর রব ঝাড়ফুঁক (কবিরাজ) করতেন বলে জানতে পেরেছি আমরা।’
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সিসিটিভি ফুটেজে যাকে বাসায় যাতায়াত করতে দেখা গেছে, আটক আবদুর রব সেই ব্যক্তি কিনা জানতে চাইলে মেজর সাদমান ইবনে আলম বলেন, ‘তাকে জিজ্ঞাসাবাদ ও তদন্ত চলছে। পুরো কার্যক্রম শেষে সবকিছু জানাবো। আপাতত তাকে সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করেছি আমরা।’
নিহত তাহমিনার বড় ছেলে মো. তাজুল ইসলাম ফয়সাল জানান, মাকে নিয়ে আজ সকালে আদালতে যাওয়ার কথা ছিল। এজন্য ঢাকা থেকে রবিবার রাতে কুমিল্লায় আসেন তিনি। রাত ১০টা ৪৫ মিনিটের দিকে বাসায় এসে দেখেন দরজা খোলা। একটা টুল দিয়ে দরজা মিলিয়ে রাখা হয়েছে। ভেতরে প্রবেশ করে দেখেন লাইট বন্ধ, প্রথম ভেবেছিলেন মা ও বোন ঘুমাচ্ছেন। লাইট অন করে রাতের খাবার দেওয়ার জন্য মা ও বোনকে ডাকাডাকি করে কোনও সাড়াশব্দ পাননি। কিছুক্ষণ পরে বোনের কক্ষে গিয়ে দেখেন তার দেহ পড়ে রয়েছে খাটের ওপর, হাত ধরতেই দেখেন, শক্ত হয়ে রয়েছে। এরপর পাশের কক্ষে গিয়ে মায়ের নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখেন। এরই মধ্যে ছোট ভাইও ঢাকা থেকে বাসায় এসে পৌঁছায়। পরে তিনি ৯৯৯-এ ফোন করেন।
তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা জানি না কে বা কারা আমার মা ও বোনকে এভাবে হত্যা করেছে। আমার কাছে অবস্থা দেখে মনে হয়েছে পুরো ঘটনাটি পরিকল্পিত, শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। কারণ, ঘর থেকে তেমন কোনও মালামাল খোয়া যায়নি। আমাদের বাড়ির কাজ চলমান থাকায় নানার এলাকায় ভাড়া থাকছি আমরা। আমাদের কোনও শত্রুও ছিল না। কিন্তু বুঝতে পারছি না কারা এভাবে আমাদের নিঃস্ব করলো।’
কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মহিনুল ইসলাম বলেন, ‘প্রাথমিক তদন্তে মনে হচ্ছে এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। তবে কীভাবে তাদের হত্যা করা হয়েছে, সেটি নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। অবস্থা দেখে ধারণা করা হচ্ছে, তাদের শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। নিহত দুজনের শরীরে তেমন কোনও আঘাতের চিহ্ন নেই। মেয়েটির গলায় একটি দাগ দেখা গেছে। আর মায়ের একটি চোখ রক্তাক্ত ছিল। সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা হচ্ছে। সন্দেহজনক ব্যক্তিটির বিষয়েও তদন্ত চলছে।’

















