সাবেক তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের বাবা নুরুচ্ছফা তালুকদারের ব্যক্তিগত গাড়িচালক ছিলেন মো. নাসির। নুরুচ্ছফার মৃত্যুর পর কর্মহীন হয়ে পড়লে বাংলাদেশ বেতার কক্সবাজার আঞ্চলিক পরিচালক (আরডি) আশরাফ কবির নাসিরকে চুক্তিভিত্তিক গাড়িচালক হিসেবে নিয়োগ দেন। অথচ বেতারে আগেই দুটি গাড়ির জন্য দুজন চালক কর্মরত ছিলেন। ফলে কোনও কাজ না করেই নাসিরকে প্রায় তিন বছর নিয়মিত বেতন দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিষয়টি প্রকাশ্যে এলে তার নিয়োগ বাতিল হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাছান মাহমুদ তথ্যমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকাকালীন ২০২১ সালে ঠাকুরগাঁও থেকে বদলি হয়ে কক্সবাজার বেতারে যোগ দেন আশরাফ কবির। সেতুমন্ত্রী ওবায়াদুল কাদেরের নিজ এলাকা নোয়াখালীর বাসিন্দা হওয়ায় আশরাফ কবিরের আলাদা প্রভাব ছিল। তথ্যমন্ত্রীকে খুশি করতে শূন্যপদ না থাকা সত্ত্বেও কৃতজ্ঞতাস্বরূপ মহেশখালীর বাসিন্দা নাসিরকে গাড়িচালক পদে নিয়োগ দেন তিনি। গত ১৬ আগস্ট বেতারের শিল্পীরা তথ্য উপদেষ্টা, বেতারের মহাপরিচালক, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাসহ বিভিন্ন দফতরে আশরাফ কবিরের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছেন। সাত জন শিল্পীর স্বাক্ষরে সুনির্দিষ্ট ১২টি অভিযোগ উত্থাপন করা হয়।
অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে কক্সবাজার বেতারের দায়িত্বে থাকা আরডি কেন্দ্রের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী সংগীত সংকলক মোসলেহ উদ্দিন এবং ক্যাজুয়াল স্টাফ নুরুল আজিমকে নিয়ে একটি সিন্ডিকেট করে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি চালিয়ে আসছেন। গত ২৮ আগস্ট অসুস্থতা জনিতকারণে মোসলেহ উদ্দিন মারা যান।
অভিযোগপত্রে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে টাকা নেওয়া, ক্যাজুয়াল স্টাফদের ভয় দেখিয়ে ঘুষ আদায়, ইউনিসেফ প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ, সরকারি ডরমিটরিতে বিনা ভাড়ায় বসবাস, বেতারের জমি ও বিদ্যুৎ ব্যবহার করে ব্যক্তিগত খামার চালানো, শত শত গাছ কেটে বিক্রি, শিল্পী সম্মানী আত্মসাৎ এবং অনিয়মের প্রতিবাদকারীদের অনুষ্ঠান থেকে বিরত রাখাসহ ১২টি অভিযোগ আনা হয়।
চুক্তিভিত্তিক গাড়িচালক মো. নাজির হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মিনহাজ নামে অপর চালককে দিয়ে এখন পিয়নের কাজ করানো হচ্ছে। এতে অতিরিক্ত চাপের কারণে আমি দুর্ঘটনার শিকার হই। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নুরুল আজিম আমাকে ফোনে ২৫ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করেন। দাবি পূরণ না করায় আমাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে তিন মাসের বেতন ৯০ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেন। বিষয়টি লিখিত অভিযোগে উল্লেখ করেছি আমি।’ তার বেতন সংক্রান্ত অডিও রেকর্ড এই প্রতিবেদকের কাছে রয়েছে।
বেতারের একাধিক কর্মচারী জানান, আরডি ও তার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কথা বললে মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসানো হতো। সম্প্রতি শাহাব উদ্দিন নামে এক ছাত্রপ্রতিনিধির স্বাক্ষর জাল করে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে রিদোয়ানুল করিম নামে এক কর্মচারীকে চট্টগ্রামে বদলি করা হয়। পরে শাহাব উদ্দিন বিষয়টি জানতে পেরে এ ঘটনার প্রতিবাদে আরডির বিরুদ্ধে মানববন্ধন করেন। এ ছাড়া আরডির স্বেচ্ছাচারিতায় অনুষ্ঠান শাখার কর্মচারী মো. ওসমান গণিসহ অনেকে চাকরি ছেড়ে দেন।
এ ব্যাপারে বেতারের সংগীতশিল্পী ও প্রযোজক দ্বীপলাল চক্রবর্তী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শিল্পীরা সম্মানের কথা ভেবে বেতারে যান। কিন্তু আরডি আশরাফ কবির শিল্পীদের প্রতি ন্যূনতম সম্মান দেখান না। কোন শিল্পীকে বেতারে ডাকবেন, তা সিন্ডিকেটের ইচ্ছের ওপর নির্ভর করে। ফলে অনেক গুণী শিল্পী যান না।’
বংশীবাদক হিসেবে ১০ বছরের বেশি সময় বেতারে কর্মরত ছিলেন প্রতিবন্ধী রেজাউল করিম। তাকে অমানবিকভাবে চাকরি থেকে বাদ দেওয়া হয়, এতে শিল্পীদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে।
কক্সবাজার জেলা সংগীতশিল্পী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ফরমান উল্লাহ বলেন, ‘বর্তমানে ব্যাংকের মাধ্যমে শিল্পী সম্মানী দিলেও সেখানেও কারচুপি করা হচ্ছে। মাসের পর মাস শিল্পীরা রেকর্ডিংয়ের টাকা পান না। শুধু শিল্পী খাত নয়, ইউনিসেফ প্রকল্প থেকেও লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এসব অনিয়ম বন্ধ না হলে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছি আমরা।’
অভিযোগের বিষয়ে গাড়িচালক মো. নাসির বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রতিদিন বেতারে গিয়ে কর্মহীন বসে থাকতে নিজেরও ভালো লাগতো না। গত আড়াই বছর আমাকে শুধুমাত্র চার-পাঁচবার গাড়ি চালাতে দেওয়া হয়। তাও ঢাকা থেকে কোনও অতিথি আসলে। কয়েক মাস আগে আমাকে বেতারে যেতে নিষেধ করা হয়। এরপর থেকে আর যাচ্ছি না। তবে আমার চুক্তি বাতিল করেছে কিনা, তাও জানি না।’
কাজ না করেও সাবেক মন্ত্রী হাছান মাহমুদের পারিবারিক গাড়িচালক নাসির তিন বছর ধরে বেতন নিয়েছেন বলে স্বীকার করেছেন কক্সবাজার বেতারের হিসাব বিভাগের হিসাব সহকারী নুরুল আজিম। তিনি বলেন, ‘সাবেক মন্ত্রী হাছান মাহমুদের সময়ে আরডি আশরাফ কবির ঠাকুরগাঁও থেকে বদলি হয়ে কক্সবাজার বেতারে আসার আগেই গাড়িচালক নাসিরকে ঢাকা থেকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেন। প্রথমে ঢাকা থেকে নাসিরের বেতন হওয়ার কথা থাকলে একটি পরিপত্র জারির মাধ্যমে কক্সবাজার অফিস থেকে বেতন দেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়। তখন আরডি আশরাফ কবির ও আমাদের করার কিছুই ছিল না। বিশেষ করে এখানকার কিছু আওয়ামী নেতাদের কারণে আমরা ছিলাম তখন কোণঠাসা। এজন্য কিছুই করতে পারিনি।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজার বেতারের আঞ্চলিক পরিচালক মো. আশরাফ কবির বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে অনেকে কালো তালিকাভুক্ত হয়েছে। এ কারণে একটি মহল অফিসে সুবিধা করতে না পেরে নানাভাবে ষড়যন্ত্র করছে। সাবেক মন্ত্রী হাছান মাহমুদের পারিবারিক গাড়িচালকের বেতনের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পরপর দুটি চিঠি দিয়ে জানিয়েছি। তবে আমি ওই গাড়িচালককে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। এ ছাড়া আমার বিরুদ্ধে ওঠা অন্যান্য অভিযোগ সঠিক নয়।’