রাজশাহীতে জুলাই অভ্যুত্থানের ঘটনায় ২৭টি মামলা হয়েছে। ঘটনার সাড়ে ১৩ মাস পর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হামলার অভিযোগে আরেকটি মামলা করা হয়েছে। এই মামলায় কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ নেতাদের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, বিভিন্ন পেশাজীবী, ব্যবসায়ী ও কোচিং সেন্টারের মালিককে আসামি করা হয়েছে। আসামিদের এমন তালিকা নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা।
অভিযোগ উঠেছে, মামলা-বাণিজ্য করতে বিত্তবানদের বেছে বেছে আসামি করা হয়েছে। মামলার নেপথ্যে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) রাজশাহীর নেতাদের মদত রয়েছে, এমন আলোচনাও ছড়িয়েছে। তবে বৃহস্পতিবার (২৫ সেপ্টেম্বর) বিকালে সংবাদ সম্মেলন করে দলীয় অবস্থান পরিষ্কার করেছেন এনসিপির মহানগরের নেতারা। তারা বলছেন, কেউ কেউ এই মামলা থেকে আসামিদের অব্যাহতি দেওয়ার নামে অর্থ দাবি করছেন বলে তারা শুনতে পাচ্ছেন। এই মামলাটিকে বাণিজ্যিক মামলা হিসেবে ব্যবহার করারও অভিযোগ এসেছে আমাদের কাছে। তবে এর সঙ্গে এনসিপির নেতারা জড়িত নন।
মামলাটির বাদীর নাম কৌশিক ইসলাম অপূর্ব। তার বাড়ি নগরীর শিরোইল কলোনি এলাকায়। গত বছরের ৫ আগস্ট রাজশাহী নগরের আলুপট্টি মোড়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে তিনি আহত হয়েছিলেন। এর ১৩ মাস ১৫ দিন পর ২০ সেপ্টেম্বর চুরি, হুমকি, মারধর ও বিস্ফোরক আইনে নগরীর বোয়ালিয়া থানায় তিনি মামলা করেছেন। মামলায় ১৩৫ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া অজ্ঞাত আরও ৫০০ থেকে ৭০০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, বেছে বেছে প্রভাবশালী বা চাকরিজীবী; যাদের মামলার ভয় দেখিয়ে বেকায়দায় ফেলা যায়, এমন লোকদের আসামি করা হয়েছে। মামলার আগে অনেকের সঙ্গেই যোগাযোগ করা হয়েছে। তাদের মামলার ভয় দেখিয়ে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে মোটা অঙ্কের টাকা। এমন অভিযোগ পেয়েছেন এনসিপির নেতারাও।
মামলার এজাহারে দেখা গেছে, ১২৯ নম্বর আসামি তামান্না ইয়াসমিন রাজশাহী সিটি করপোরেশনের একজন অফিস সহকারী। এজাহারে তাকে আওয়ামী লীগের অর্থদাতা বলা হয়েছে। আওয়ামী লীগের চিহ্নিত নেতাদের সঙ্গে আরও আছেন সিটি করপোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর মাহাতাব চৌধুরী, ব্যবসায়ী এনায়েতুর রহমান, হোটেল ডালাসের মালিক ডলার, খাদ্য বিভাগের পরিবহন ঠিকাদার সমিতির নেতা ইয়াসির আরাফাত এবং মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা হামিদুল আলম।
চাকরিজীবীদের মধ্যে আছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সহ-উপাচার্য আনন্দ কুমার সাহা, মসজিদ মিশন স্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষক নুরুজ্জামান খান, রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ নওশাদ আলী ও তবিবুর রহমান শেখ, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের কর্মচারী সংসদের সভাপতি তৌফিক, রাকাবের কর্মচারী হাসিবুল ইসলাম, আশরাফুল ইসলাম, জালাল উদ্দিন ও আমিনুল ইসলাম, রাজশাহী সিটি করপোরেশনের কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি আজমির আহমেদ মামুন, সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা কৌশিক দত্ত, ফররুখ আহমেদ, রতন আলী, কামাল পারভেজ, এ বি এম আসাদুজ্জামান, নাদিম নাহিয়ান, নাজমা ইসলাম, অমিত রানী শান্তা, রাজু আহমেদ, পাপড়ি খাতুন ও রেজওয়ানুল হুদা, রেলওয়ের বিভাগীয় প্রকৌশলী নাজিব কোরাইশ, রেলের কর্মকর্তা জসিম উদ্দিন, সাবির উদ্দিন, মোহাম্মদ ফরহাদ মজুমদার, তাহেরুল ইসলাম, জান্নাতুন ঝিলিক, আকতার আলী ও ইকবাল হোসেন, রাজশাহী ওয়াসার নির্বাহী প্রকৌশলী সোহেল রানা ডন ও তার স্ত্রী সায়েরা বানু এবং এনা গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক সারওয়ার জাহান।
রাজনীতি না করলেও মামলায় কয়েকটি কোচিং সেন্টারের মালিককেও আসামি করা হয়েছে। তারা হলেন জুয়েল কেমিস্ট্রির পরিচালক আসাদুজ্জামান জুয়েল, জাহিদ ফিজিকসের পরিচালক জাহিদ হাসান, দেবাশীষ ফিজিকসের পরিচালক দেবাশীষ, চঞ্চল ফিজিকসের পরিচালক আবদুল ওহাব চঞ্চল ও উজ্জ্বল ম্যাথ ক্লাবের উজ্জ্বল হোসেন।
ঘটনা মহানগরের হলেও গ্রামের অনেক জনপ্রতিনিধিও মামলায় আসামি হয়েছেন। তারা ধনী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। তাদের মধ্যে রয়েছেন গোদাগাড়ী উপজেলার পাকড়ি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জালাল উদ্দিন, মাটিকাটা ইউপির চেয়ারম্যান সোহেল রানা, কাঁকনহাটের সাবেক মেয়র আবদুল মজিদ, কাটাখালী পৌরসভার সাবেক নারী কাউন্সিলর আয়েশা বেগম, তানোরের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান লুৎফর হায়দার রশীদ ময়না ও সাবেক মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান সোনিয়া সরদার।
মামলায় আসামি হয়েছেন, এমন একজন প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, এর আগেও তাকে একটি মামলায় আসামি করা হয়েছিল। অথচ তিনি কোনও রাজনীতি করেন না। চাকরি রক্ষায় মিথ্যা মামলার ওই বাদীর সঙ্গে আপস করতে বাধ্য হন। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে বাদী তাকে অ্যাফিডেভিট করে দেন যে ভুল করে এজাহারে তার নাম দেওয়া হয়েছিল। এই মামলাতেও একই কারণে ধনী ব্যক্তিদের বেছে বেছে আসামি করা হয়েছে বলে তার ধারণা। তবে এবার তিনি আর টাকা দিয়ে অ্যাফিডেভিট করে নিতে চান না।
এ ব্যাপারে কোনও কথা বলতে চাননি মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বোয়ালিয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) শরিফুল ইসলাম। মামলার বাদী কৌশিক ইসলাম অপূর্বের মুঠোফোন নম্বরটি বন্ধ পাওয়া গেছে। মামলা সাক্ষীদের ফোন নম্বর না থাকার কারণে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
মামলার বিষয়টি জানাজানি হলে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। এ নিয়ে এনসিপির মহানগরের প্রধান সমন্বয়কারী মোবাশ্বের আলী দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখানে তিনি বুধবার রাতে ফেসবুকে দেওয়ার তার একটি স্ট্যাটাসও পড়ে শোনান।
মামলার বাদী তাদের সুপরিচিত উল্লেখ করে মোবাশ্বের আলী লিখেছেন, ‘রাজশাহীতে ১৩৫ জনকে আসামি করে জুলাই আহত অপূর্ব নামের এক ছেলে গত কয়েক দিন আগে বোয়ালিয়া থানায় একটা মামলা করেছেন। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই মামলা জাতীয় নাগরিক পার্টি, রাজশাহীর পক্ষ থেকে হয়েছে বলে সব মহলে ব্যাপক আলাপ-আলোচনা চলছে। আমি খুব শক্তভাবে ঘোষণা করছি, আমরা পার্টির কেউ এই মামলার সঙ্গে কোনোভাবে জড়িত নই। মামলাটির পর জেনেছি এবং এই মামলা নিয়ে বিভিন্নভাবে নানা ফোন পাচ্ছি। কেউ কেউ এই মামলা নিয়ে আসামিদেরকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার নামে বড় অঙ্কের অর্থ দাবি করছে শুনতে পাচ্ছি। এই মামলাকে বাণিজ্যিক মামলা হিসেবে ব্যবহার করারও অভিযোগ এসেছে আমাদের কাছে।’
মোবাশ্বের আলী সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আমরা রাজশাহী মহানগর এনসিপি দ্ব্যর্থহীনভাবে এসব নোংরামিকে প্রত্যাখ্যান করছি। রাজশাহী মহানগর ও রাজশাহী জেলার কোনও নেতা কারও কাছে এই মামলা নিয়ে অর্থ লেনদেনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হলে তার বিরুদ্ধে রাজশাহী সংগঠন কঠোর ব্যবস্থা নেবে।’
মোবাশ্বের আলী বলেন, ‘এই মামলায় কোনও নির্দোষ ব্যক্তিকে যদি সত্যি সত্যিই জড়ানো হয়ে থাকে, যারা জুলাইয়ে রাজশাহীতে সন্ত্রাসী আওয়ামী বাহিনীর সঙ্গে মাঠে-ময়দানে ছিল না এবং নেপথ্যেও তাদের সহযোগিতার কোনও তথ্য-প্রমাণ নেই, এ রকম যারা আছেন, তারা যোগাযোগ করলে নিরাপরাধ ব্যক্তিদের পাশে দাঁড়াবো। মামলা করার পর বাদীও নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন। এমন যদি হয়, তাহলে নিরাপত্তার প্রয়োজনে তারও পাশে থাকবো আমরা।’
একই প্রেক্ষাপটে ২৭টি মামলার পর কেন আরও একটি মামলা করতে হলো সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে মোবাশ্বের আলী বলেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে এখন যে মামলাগুলো হচ্ছে, সেগুলো একটি কমিটি দেখেশুনে করছে। সেই কমিটির প্রধান হচ্ছে পুলিশ কমিশনার। হয়তো তারা গবেষণা করেই মামলা করেছেন। হয়তো ফ্যাক্ট চেকিং করে মামলা করতে বাদী সময় নিয়েছেন। বাদী জুলাই আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ ব্যক্তি। চিকিৎসার প্রয়োজনেও তার দেরি হতে পারে।’
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, অভ্যুত্থানের অনেক দিন পার হয়ে যাওয়ায় এখন ওই ঘটনায় কেউ মামলা করতে চাইলে নির্ধারিত কমিটির অনুমোদন নিতে হবে। এজন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। যার আহ্বায়ক রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনার। কমিটির অনুমোদনের পর মামলাটি নথিভুক্ত করা হয়েছে।
রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনার আবু সুফিয়ান বলেন, ‘মামলাটি কমিটি অনুমোদন করেছে। এমনকি পিপিও (সরকারি কৌঁসুলি) দেখেছেন। অনেক দিন থেকেই তারা এই মামলা রেকর্ড করার জন্য চেষ্টা করছিলেন। কমিটি অনেক কিছু সংশোধন করেছে। তারপরও কিছু বিতর্ক রয়ে গেছে। এগুলো আমরা তদন্ত করে দেখবো।’

















