জুলাই আন্দোলনে গুলিতে চোখ হারানোর পর এবার পরিবর্তনের মশাল হাতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচনে লড়ছেন শুভ হোসেন। জুলাই মাসের ঐতিহাসিক আন্দোলনে গুরুতর আহত এই শিক্ষার্থী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সমাজসেবা ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। চাকসুর এই গুরুত্বপূর্ণ পদে প্রার্থী হতে শুভ একাধিক প্রভাবশালী প্যানেল থেকে প্রস্তাব পেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি দৃঢ়ভাবে স্বতন্ত্র পরিচয়েই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন।
এর মূল কারণ ব্যাখ্যা করে শুভ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জুলাইয়ের আন্দোলনের পর দেশ পুনর্গঠনের পথে যে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন বাধা সৃষ্টি করছে, আমি তা দূর করতে চাই। আমার এই নির্বাচনি লড়াই কেবল পদ দখলের নয়, বরং রাজনৈতিক শুদ্ধিকরণ এবং বাংলাদেশ বিনির্মাণের সেই মূল চেতনাকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াই।’
সমাজসেবা ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক পদ বেছে নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে শুভ বলেন, ‘সমাজসেবা পদে মূলত সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে এসেছি। আমাদের নতুন সমাজ বিনির্মাণের সুযোগ এসেছে। আমি বিশ্বাস করি, আমি অন্ধ হয়ে আমার যে সংগ্রামটা থেমে যায়নি, বরং দায়িত্ব আরও বেড়ে গিয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে দৃষ্টিদান ফাউন্ডেশন নামে একটি সামাজিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছি। যেটি মানবাধিকার, শিক্ষা ও পরিবেশ নিয়ে কাজ করে দেশের ৬৪টি জেলায়। তো ওইসব পোর্টফোলিওর সঙ্গে মিল রেখে অভিজ্ঞতার বিচিত্রতার ভিত্তিতে এই পদে এসেছি।’
নির্বাচনি ইশতেহার
নির্বাচনের ইশতেহার দিয়ে শুভ বলেন, ‘আমার প্রথম ইচ্ছে হচ্ছে চাকসু নির্বাচনে আমি যত হাজার ভোটে জয়লাভ করবো, তত হাজার গাছ নিজ হাতে সারা বাংলাদেশে রোপণ করবো। দ্বিতীয়ত, বিশ্ববিদ্যালয়ে অবহেলিত যে সকল প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী ভাই-বোনেরা আছে তাদের পাশে থেকে এবং পক্ষ হয়ে সম্পূর্ণ দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করতে চাই। এ ছাড়া সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়সহ যাবতীয় কল্যাণে সব সময় কাজ করে যাবো।’
শুভর বর্তমান অবস্থা
মো. শুভ হোসেন বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের একজন শিক্ষার্থী। তার জন্ম লক্ষ্মীপুর সদরের একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে। পারিবারিক দিক থেকে তার বাবা একজন প্রবাসী।
আন্দোলনের সময় ছাত্রলীগের (নিষিদ্ধঘোষিত) ছোড়া একটি বুলেট তার ডান চোখে আঘাত হানে। বুলেটটি তার ডান চোখ ভেদ করে তিনটি স্তর অতিক্রম করে ভেতরে আটকে যায়। এই ভয়াবহ আঘাতের ফলস্বরূপ, শুভ তার ডান চোখের দৃষ্টিশক্তি সম্পূর্ণভাবে হারিয়েছেন। দুঃখজনকভাবে এ আঘাতের কারণে তার অন্য চোখেও প্রভাব পড়েছে এবং সেটির দৃষ্টিশক্তিও কমে গেছে।
আহত হওয়ার পর শুভকে প্রথমে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং পরে ঢাকা চক্ষু ইনস্টিটিউটে নেওয়া হয়। সেখানে তার চোখে তিনবার অস্ত্রোপচার করা হলেও চিকিৎসকরা এখন পর্যন্ত চোখ থেকে সেই বুলেটটি বের করতে পারেননি, যা তাকে প্রতিনিয়ত যন্ত্রণার মুখোমুখি করছে। চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এই আঘাতের ফলে শুভ আর কখনও দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবেন না।
জুলাই আন্দোলনে ভূমিকা
আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার কারণ সম্পর্কে শুভ জানান, গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা, শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতকরণ এবং একটি মানবিক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার জন্যই তিনি আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন।
জুলাই আন্দোলনের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘২০২৪ সালের ১৬ জুলাই চট্টগ্রামের মুরাদপুরে আন্দোলনে গিয়ে অর্থাৎ প্রথম দিনেই ওই জায়গাতেই অন্ধত্ববরণ করি। স্বৈরাচারের দোসররা যখন ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া দিচ্ছিল। একপর্যায়ে ওদের ধাওয়া খেয়ে অন্যদের সঙ্গে আমিও পিছু হটছিলাম। তখন হঠাৎ গুলির আওয়াজ শুনতে পাই এবং ভাবলাম কেউ আহত হয়েছে কি না বা পড়ে গিয়েছে কি না, একা কেন পালাবো, যদি কেউ থাকে তবে তাকে নিয়ে পালাবো। এই ভেবে পেছনে তাকাই ঠিক ওই মুহূর্তে একটি বুলেট এসে ডান চোখে আঘাত হানে এবং সঙ্গে সঙ্গে আমি মাটিতে পড়ে যাই।’
নির্বাচনি প্রচারণা
দীর্ঘ তিন যুগ পর আগামী ১৫ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বহুল প্রতীক্ষিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচন। এই নির্বাচনকে ঘিরে ক্যাম্পাসজুড়ে এখন নির্বাচনি আমেজ তুঙ্গে। বিভিন্ন প্যানেল এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা পুরোদমে প্রচার-প্রচারণায় ব্যস্ত। তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, নানা প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও প্রচার চালাচ্ছেন শুভ। তার দৃঢ় মনোবলের প্রচার নজর কাড়ছে সবার।
এর আগে, চাকসু নির্বাচনে ‘ভয়েস অফ সিইউ’ (Voice of CU) নামের একটি প্যানেল একটি প্রশংসনীয় সিদ্ধান্ত নেয়। জুলাই আন্দোলনে চোখ হারানো শুভর সম্মানে তারা ‘সমাজসেবা ও পরিবেশবিষয়ক’ সম্পাদক পদে কোনও প্রার্থী দেয়নি।
তবে শুভ স্পষ্ট জানিয়েছেন যে, তিনি কারও করুণা নিয়ে নির্বাচনে আসতে চান না। তার এই বলিষ্ঠ অবস্থানের জন্য তিনি বাকি যে প্যানেলগুলো প্রার্থী দিয়েছে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
উল্লেখ্য, এই নির্বাচনে অন্যান্য প্যানেল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষ থেকে তার বিপরীতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ১৯ জন প্রার্থী।