রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার খেতুরীতে অনুষ্ঠিত শ্রীশ্রী নরোত্তম দাস ঠাকুরের তিরোভাব তিথি মহোৎসবে এবারে রেকর্ডসংখ্যক দর্শনার্থীর সমাগম হয়েছে। তিন দিনব্যাপী এ মহোৎসবে অংশ নিতে দেশ-বিদেশ থেকে আসা প্রায় ১৫ লাখ বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীর পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠেছে খেতুরীধাম ও আশপাশের এলাকা।
গৌরাঙ্গদেব ট্রাস্ট বোর্ডের সভাপতি বিদ্যুৎ নারায়ণ সরকার বলেন, ‘এবার দর্শনার্থীর সংখ্যা আগের সব বছরের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। আমরা ধারণা করছি, ১৫ লাখেরও বেশি ভক্ত-অনুসারী এখানে এসেছেন। এতো মানুষের আগমন অতীতে আর কখনও দেখিনি। তবে আনন্দের বিষয়, উৎসব সুন্দরভাবেই চলছে, রাস্তাঘাটে সামান্য যানজট ছাড়া কোথাও কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।’
জানা গেছে, বিশ্বজুড়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ছয়টি ধামের একটি এই খেতুরীধাম। ১৫৩১ খ্রিষ্টাব্দে গোদাগাড়ীর গোপালপুর পরগণার রাজা কৃষ্ণানন্দ দত্তের ঘরে জন্ম নেন নরোত্তম দাস ঠাকুর। বৈষ্ণবদের বিশ্বাস, চৈতন্যদেবের আহ্বানেই তার আবির্ভাব হয়। অহিংস সাধনা ও ভক্তিবাদের প্রতীক এই মহাপুরুষ ছিলেন ১৬১১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত।
খেতুরীতেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ছয়টি শ্রীবিগ্রহ, শ্রীগৌরাঙ্গ, শ্রীবল্লবীকান্ত, শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীব্রজমোহন, শ্রীরাধামোহন ও শ্রীরাধাকান্ত। তার জীবদ্দশায় শুরু হওয়া এই ধর্মীয় আয়োজন শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে আজও ঐতিহ্য বহন করে আসছে। দুর্গাপূজার পর তিন দিনব্যাপী এই মহোৎসব ঘিরে বসে বিশাল গ্রামীণ মেলা। এবারের উৎসব শুরু হয়েছে শুক্রবার, চলবে রবিবার পর্যন্ত। এবার বিপুল দর্শনার্থীর কারণে গোদাগাড়ীর রাজাবাড়িহাট থেকে বসন্তপুর ও বিজয়নগর থেকে প্রেমতলী বাজার পর্যন্ত দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। শনিবার (১১ অক্টোবর) সকালে এই যানজট ঠেলে উৎসব প্রাঙ্গণে গিয়ে ভক্তদের শুভেচ্ছা জানান বিভাগীয় কমিশনার খোন্দকার আজিম আহমেদ।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন– জেলা প্রশাসক আফিয়া আখতার, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মহিনুল হাসান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফয়সাল আহমেদ এবং সহকারী কমিশনার (ভূমি) শামসুল ইসলাম।
এ ছাড়াও আরও উপস্থিত ছিলেন– ইসকন বাংলাদেশের সহ-সভাপতি শ্রীমৎ ভক্তি অদ্বৈত নবদ্বীপ স্বামী মহারাজ, জেনারেল সেক্রেটারি শ্রী চারুচন্দ্র দাস ব্রহ্মচারী, ইসকন বাংলাদেশের কার্যকরী কমিটি সদস্য শ্রী বিমলা প্রসাদ দাস এবং কার্যকরী কমিটি সদস্য অধ্যক্ষ শ্রী পার্থসারথি কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী।
বিভাগীয় কমিশনার বলেন, ‘খেতুরীর এই মহোৎসব শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি রাজশাহী অঞ্চলের আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের একটি অনন্য নিদর্শন। লাখো মানুষের অংশগ্রহণ প্রমাণ করে যে সনাতন ধর্মের ভক্তি ও সৌহার্দ্যের ধারা এখনও কতটা জীবন্ত। প্রশাসন ও স্থানীয় জনগণের সহযোগিতায় উৎসব শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হচ্ছে।’
জেলা প্রশাসক বলেন, ‘এবার দর্শনার্থীর সংখ্যা রেকর্ডসংখ্যক হলেও আমরা আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। নিরাপত্তা, চিকিৎসা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা ও স্বেচ্ছাসেবকদের সহযোগিতায় পুরো আয়োজনটি খুব সুন্দরভাবে সম্পন্ন হচ্ছে।’
গোদাগাড়ীর ইউএনও ফয়সাল আহমেদ বলেন, ‘উৎসব শান্তিপূর্ণভাবে চলছে। নিরাপত্তা নিশ্চিতে পুলিশ ও ট্রাফিক বিভাগের পর্যাপ্ত সদস্য মোতায়েন আছেন। তবে দর্শনার্থীর সংখ্যা এত বেশি যে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে কিছুটা চাপ তৈরি হয়েছে।’
চার শতাব্দী পুরোনো এই নরোত্তম দাস ঠাকুরের তিরোভাব তিথি মহোৎসব এখন কেবল ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, রাজশাহী অঞ্চলের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল প্রতীক হয়ে উঠেছে।