জমি দখল ও চাঁদাবাজির মামলা থেকে ময়মনসিংহের ভালুকায় বহিষ্কৃত বিএনপি নেতা ফখরুদ্দিন আহমেদ বাচ্চুর নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। তার নাম বাদ দিয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আদালতে প্রতিবেদন দিলে তাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেন বিচারক। অভিযোগ উঠেছে, বড় অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে মামলার চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করিয়েছেন বাচ্চু। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ভুক্তভোগীরা।
আলোচিত এ ঘটনায় কীভাবে একজন চিহ্নিত অভিযুক্ত ব্যক্তির নাম ডিবি পুলিশের চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন থেকে বাদ দেওয়া হলো, সেটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সচেতন মহল। এ ঘটনার পর জনমনে আতঙ্ক বিরাজ করছে। অভিযোগ উঠেছে, এরই মধ্যে বাচ্চু স্থানীয় পর্যায়ের দলীয় ও বিভিন্ন ব্যবসায়ীকে হুমকি দিচ্ছেন।
বাচ্চু ছিলেন বিএনপির ময়মনসিংহ দক্ষিণ জেলার যুগ্ম আহ্বায়ক ও ভালুকা উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক। ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে ভালুকার এলজি বাটারফ্লাই ম্যানুফেকচারিং কোম্পানির কাছে চাঁদাবাজির অভিযোগ এনে ভালুকা থানা একটি মামলা করা হয়েছিল। যার পরিপ্রেক্ষিতে শৃঙ্খলাবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত থাকার সুস্পষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে বাচ্চুকে দলের প্রাথমিক সদস্যপদসহ সব পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় বিএনপি। গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানানো হয়। পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে ভালুকার ব্র্যাক এনজিওর নার্সারির জমি দখলের অভিযোগ ওঠে। এসব ঘটনায় ৩ সেপ্টেম্বর বাচ্চুসহ ১৫-২০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল বিএনপি।
দলের নাম ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অনৈতিক সুবিধা আদায়ের অভিযোগে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে ভালুকা থানায় মামলাটি করেন দলটির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স। এজাহারে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করা হয়েছিল।
এরই মধ্যে ভালুকার এলজি বাটারফ্লাই ম্যানুফেকচারিং কোম্পানির কাছে চাঁদাবাজির ঘটনায় করা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ভালুকার আমলি আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। আদালত ওই প্রতিবেদন আমলে নিয়ে বাচ্চুকে অব্যাহতি দেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ভালুকা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হুমায়ুন কবির বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মামলাটি তদন্ত করেছে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। তদন্ত শেষে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে তারা। তবে বাচ্চুর নাম কীভাবে মামলা থেকে বাদ পড়েছে, তা বলতে পারবো না। ডিবি পুলিশ বলতে পারবে।’
অর্থের বিনিময়ে মামলার চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন থেকে বাচ্চুর নাম বাদ দেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি-দক্ষিণ) মহিদুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এ ব্যাপারে অনেকে অনেক কিছু বলতে পারে। কিন্তু এসবের সত্যতা নাই। তদন্ত সাপেক্ষে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। ইচ্ছে করলে বাদী পক্ষ এতে নারাজি দিতে পারেন।’
এদিকে, বাচ্চু দলের নাম ভাঙিয়ে এমপি নির্বাচনের প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। দলের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে নিজস্ব দলবল নিয়ে দলীয় কার্যক্রমের পাশাপাশি চাঁদাবাজি অব্যাহত রেখেছেন।
দলীয় কয়েকজন নেতাকর্মী জানিয়েছেন, বাচ্চু তৃণমূল কর্মীদের মাঝে ছড়িয়েছেন যে তিনি দলের স্থায়ী কমিটির কয়েকজনকে ম্যানেজ করেছেন এবং দলীয় মনোনয়ন পাবেন বলে বেড়াচ্ছেন। চাঁদাবাজির মামলা থেকে নাম বাদ দিতে সম্প্রতি বাচ্চুর পক্ষের কিছু লোকজন ভালুকা থানার সামনে বিক্ষোভও করেছিলেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে উপজেলা বিএনপির দুজন নেতা জানিয়েছেন, কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে বাচ্চুর ভগ্নিপতি নেত্রকোনা জেলা পুলিশের ডিবির পরিদর্শক সাইদুলের মধ্যস্থতায় দলের হাইকমান্ডকে উপেক্ষা করে ডিবির কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে মামলা থেকে নাম কাটিয়েছেন বাচ্চু। এরপর থেকে তার অনুসারীরা এলাকায় লোকজনকে বলে বেড়াচ্ছেন, ‘মামলা শেষ করেছি ৫ কোটিতে, মনোনয়ন-বহিষ্কার প্রত্যাহার করাবো ৫০ কোটিতে। তারপর ১৫ দিনে ভালুকা থেকে এই টাকা তুলে ফেলবো’।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে উপজেলা বিএনপির আরেক নেতা বলেন, ‘দলে যদি পুনরায় বহিষ্কৃত নেতাকর্মীকে মূল্যায়ন করা হয়, তাহলে সারা দেশে বিএনপির চেইন অব কমান্ড সম্পর্কে জনগণের মধ্যে খারাপ ধারণা সৃষ্টি হতে পারে এবং চাঁদাবাজিসহ অন্যান্য অনিয়মের পুনরাবৃত্তি ঘটার শঙ্কা আছে।’
ভালুকা উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘উচ্ছৃঙ্খল কর্মকাণ্ড, চাঁদাবাজি, জমি দখল, সংগঠনবিরোধী কার্যকলাপসহ নানা কারণে দলের প্রাথমিক সদস্যপদ ফখরুদ্দিন আহমেদ বাচ্চুকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি গায়ের জোরে সবকিছু করছেন। আইন-কানুনের তোয়াক্কা কখনও করেননি। সাধারণ মানুষের কাছে তার কোনও গ্রহণযোগ্যতা নেই। সবাই তাকে ভয় পায়। বিশেষ করে তৃণমূল বিগত কর্মকাণ্ডে মন থেকে মুছে ফেলছে। এখন মামলা থেকে তার নাম বাদ দেওয়া হলো।’
এসব বিষয়ে ময়মনসিংহ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ ইমরান সালেহ প্রিন্স জানান, ইতিমধ্যে বাচ্চুর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তারপরও কীভাবে দলীয় প্রচারণা চালায়, তা আমার জানা নেই। একটা মুরগি একবারই জবাই হয়। দল থেকে তাকে কোনও গ্রিন সিগন্যাল, রেড সিগন্যাল, হোয়াইট সিগন্যাল দেওয়া হয়নি। সারা দেশেই যারা সংগঠনবিরোধী কাজ করছে, তাদের দল থেকে সম্পূর্ণভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে দলের হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।