দেশের পোশাক খাতে অগ্নিকাণ্ডের ভয়াল ঘটনা তাজরীন ট্র্যাজেডি। তাজরীন ফ্যাশনসের পরিত্যক্ত ভবনটির দেয়ালে এখনও আছে সেই দিনের আগুনের লেলিহান শিখার চিহ্ন ও ভয়াবহতার ছাপ। অন্যান্য দিনের মতো এদিন সকালে কাজে যোগ দিয়েছিলেন কারখানার হাজারো শ্রমিক। সন্ধ্যা নামতেই হঠাৎ ভবনের আটতলায় আগুনের সূত্রপাত। মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে পুরো ভবনে। জীবন বাঁচাতে কেউ কেউ লাফিয়ে পড়েন। এর মধ্যে দিনের আলোর সঙ্গে সেদিন নিভে গিয়েছিল অনেকের প্রাণ। সন্ধ্যায় শ্রমিকদের বাঁচার আকুতিতে ভারী হয়ে ওঠে আশপাশ। সবার এখনও মনে আছে দুঃসহ সেই স্মৃতি। সেই স্মৃতি বয়ে বেড়ান শ্রমিকরা।
২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর সন্ধ্যায় সাভারের আশুলিয়ার ইয়ারপুর ইউনিয়নের নিশ্চিন্তপুর এলাকায় তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেড নামে ওই ভবনে অগ্নিকাণ্ডে ১১৭ জন শ্রমিক দগ্ধ হয়ে মারা যান। আহত হন আরও দুই শতাধিক। এ ঘটনার ১৩ বছর পূর্তিতে নিহত শ্রমিকদের স্বজন, আহত শ্রমিক ও বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা ক্ষতিগ্রস্ত ভবন ভেঙে আহত শ্রমিকদের বাসস্থান, শ্রমিকদের জন্য হাসপাতাল নির্মাণ, নিহত ব্যক্তিদের এক জীবনে আয়ের সমপরিমাণ অর্থ ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। সেই সঙ্গে তারা আহত শ্রমিকদের সুচিকিৎসা, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা এবং অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার জন্য দায়ী মালিকসহ অন্যদের বিচার নিশ্চিত করা দাবি তুলেছেন। বেঁচে ফেরা অনেকে আর ফিরতে পারেননি স্বাভাবিক জীবনে। এখনও পুনর্বাসিত না হওয়ায় আক্ষেপ আছে আহতদের।
এমন দৃশ্য জীবনে দেখিনি
সন্ধ্যার দিকে লাগা সেই আগুনের ঘটনা আজও মনে পড়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের। সেদিন বাড়িতে ছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা কামরুল হাসান। তিনি বলেন, ‘প্রায় ১৫ বছর ধরে আমি এখানে থাকি। ঘটনার সময় আমি পাশেই ছিলাম। আমার ঘরও পুড়ে গিয়েছিল সেদিন। কিছুই বের করতে পারিনি। বহু দুর্ঘটনা দেখছি। কিন্তু এত বড় দুর্ঘটনা জীবনে দেখিনি। কী যে ছিল বাঁচার হাহাকার। সহায়তা করার কোনও উপায় ছিল না। মানুষ বাঁচার জন্য এত কিছু করলো। কিন্তু বাঁচতে পারেনি। তারা কাজ করছিল। সন্ধ্যায় লাগা আগুন সারারাত ধরে জ্বলছিল। অ্যাম্বুলেন্সের আওয়াজ ছিল সারারাত। কত মানুষ লাফিয়ে পড়েছিল। রডের ওপর পড়েছে অনেকে। আর বাঁচার কী আকুতি। সেদিনের দৃশ্য মনে হলে এখনও ভয়ে আঁতকে উঠি।’
নজরুল ইসলাম নামে স্থানীয় আরেক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ‘আগুনের কথা শুনে দৌড়ে এখানে আসি। এসে দেখি দাউদাউ করে জ্বলছে। তাপ ছড়িয়ে পড়ে আশপাশেও। অনেকে ঘরের চালের ওপর লাফিয়ে পড়েছিল। অনেকেই পুড়ে মারা যায়। বীভৎস সেই দৃশ্য এখনও চোখে ভাসে।’
মেলেনি উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ, হয়নি পুনর্বাসন
সেদিনের দুঃসহ স্মৃতি এখনও বয়ে বেড়ান ভুক্তভোগী শ্রমিক ও তাদের পরিবারের স্বজনরা। আহত শ্রমিকরা অনেকে সাময়িক সহায়তা পেলেও উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পাননি। তাদের করা হয়নি পুনর্বাসন। পোড়া শরীর, পঙ্গু দেহ নিয়ে জীবন বয়ে বেড়াচ্ছেন তারা। জীবিকা নির্বাহে অনেকে শুরু করেছেন নতুন পেশা। তাদের চাওয়া, কারখানাটি ফের চালু হোক। আহতদের বাসস্থান অথবা কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নেওয়া হোক।
আহতদের একজন সবিতা রানি। তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেডের সুইং অপারেটর ছিলেন। ভালো বেতন পেতেন। ঘটনার দিন তিনতলায় ছিলেন। সন্ধ্যায় হঠাৎ বেজে ওঠা কারখানার ফায়ার অ্যালার্ম শুনে আঁতকে ওঠেন। ততক্ষণে ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে তার ফ্লোরে। এরপর অনেকের সঙ্গে তিনতলা থেকে লাফিয়ে পড়েন। অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর থেকে শুরু হয় তার অনিশ্চিত জীবনের পথচলা।
তিনি জানান, দীর্ঘ চিকিৎসা শেষে পেটের দায়ে কাজে ফিরেছেন। তবে কারখানায় কাজ করার মতো শারীরিক ক্ষমতা হারিয়েছেন। অনেক কারখানায় ঘুরেও কাজ না পেয়ে আহত শ্রমিকদের মধ্যে কয়জনকে নিয়ে একটি কারখানা তৈরি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পুঁজির অভাবে সেটা সম্ভব হয়নি।
সবিতা বলেন, ‘এরপর অনেক কষ্টে একটা সেলাই মেশিন কিনে বাসায় টুকটাক সেলাইয়ের কাজ করছি। আমার দিন খুব কষ্টে যাচ্ছে। ভারী কোনও কাজ করতে পারি না। ব্যথা-যন্ত্রণায় প্রতিদিন রাতে কান্না করে ঘুমাই। ঘুম নেই। পরিবারের ওপর বোঝা হয়ে আছি। এই জীবন থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো।’
তিনি আরও বলেন, ‘দুর্ঘটনার পর সরকার যে সাহায্য করেছে তা চিকিৎসার পেছনেই শেষ হয়ে গেছে। আমরা সাহায্য চাই না, ক্ষতিপূরণ চাই। কোনও ধরনের ক্ষতিপূরণ পাইনি। সরকার ও বিজিএমইএ যেন একটা ব্যবস্থা করে দেয়। সরকার আশ্বাস দিয়েছে, এগুলো বাস্তবায়ন করলে তাও একটু বাঁচতে পারবো। যারা মরে গেছে তারাই বেঁচে গেছে। আমরা যারা বেঁচে আছি, ধুঁকে ধুঁকে মরছি। ১৩ বছর চলে গেলো, কিছুই পেলাম না।’
সীমা আক্তার নামে আরেক শ্রমিক বলেন, ‘কারখানার জায়গাটি ১৩ বছর ধরে এভাবে ফেলে রেখেছে। এটি হয় চালু করুক, না হয় আমাদের থাকার জায়গা করে দিক। আমরা তো কাজ করতে পারছি না। কোনও সহযোগিতা পাইনি। কিছু টাকা পেয়েছি। কিন্তু আর কাজ করতে পারি না। আমরা কী মানুষ না, আমাদের কী বাঁচার অধিকার নাই। আমাদের দেখার কেউ নাই। নতুন সরকারের কাছে আশা এটাই যে, তারা আমাদের দিকে তাকাবে। আমাদের বিচারের দাবি পূরণ করবে। নভেম্বর এলে ডাকাডাকি করে অনেকে। কিন্তু কিছু পাই না। ঘর ভাড়া, দোকানে বাকি দিতে পারি না। ওষুধের টাকা নাই। আগুনে জীবনটাই শেষ হয়ে গেলো।’
নিহতদের পরিবারকে সহায়তা, আহতদের চিকিৎসার দাবি শ্রমিকনেতাদের
আহত হয়ে একদিকে অক্ষম, অন্যদিকে কর্মহীনতায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়া শ্রমিকদের জন্য সরকার ও সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। সেইসঙ্গে ঘটনায় জড়িতদের বিচার চান শ্রমিকনেতারা।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ও সোয়েটার্স শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির আইন বিষয়ক সম্পাদক খায়রুল মামুন মিন্টু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তাজরীনে অগ্নিকাণ্ডে শ্রমিক নিহতের ঘটনার ১৩ বছর পেরিয়ে গেলেও শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ কিংবা পুনর্বাসন হয়নি। কিছু সহযোগিতা করা হয়েছে। কিন্তু সঠিক পুনর্বাসন হয়নি। তারা কষ্টে জীবনযাপন করছেন। চিকিৎসা পাচ্ছেন না। সরকার যাতে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয় সে দাবি জানাই।’
বিপ্লবী গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের (বিজিএসএফ) কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি অরবিন্দু বেপারী বলেন, ‘মালিকপক্ষ সুপরিকল্পিতভাবে অগ্নিকাণ্ড ঘটিয়ে শতাধিক শ্রমিকের মৃত্যু ঘটায়। আজ পর্যন্ত মৃতদের স্বজনরা ক্ষতিপূরণ পাননি। আহত শ্রমিকরা সুচিকিৎসা পাননি। সহযোগিতাও পাননি। এখানে হত্যাকাণ্ড ঘটালেও আগের সরকার মালিককে নামমাত্র গ্রেফতার করেছিল। তারপর জামিনে মুক্তি পায়। এরপর মৎস্যজীবী লীগের সভাপতি হয়ে দাপট দেখিয়ে ঘুরে বেড়ায়।। বর্তমান সরকারের কাছে দাবি জানাই, আগের সরকারের আমলে শ্রমিক হত্যার বিচার হয়নি। এই সরকার যেন তদন্ত করে শ্রমিক হত্যার সঠিক বিচার করে। পাশাপাশি ওই কারখানার যে পরিত্যক্ত জমি রয়েছে সেখানে একটি শ্রমজীবী হাসপাতাল করে সরকারের অর্থায়নে শ্রমিকদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।’
















