খুলনা নগরের লবণচরা থানা এলাকায় ট্রিপল হত্যার রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশ। পাশাপাশি হত্যার মূলহোতাসহ তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। জমিজমা নিয়ে বিরোধের জেরে জেলে বসে এ হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করা হয়। জেল থেকে বেরিয়ে এক লাখ টাকায় ভাড়াটে খুনি দিয়ে হত্যা করানো হয়।
শনিবার (২৯ নভেম্বর) দুপুরে প্রেস ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানিয়েছেন খুলনা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার আবু রায়হান মুহাম্মদ সালেহ।
গত ১৬ নভেম্বর লবণচরার টুটপাড়া দরবেশ মোল্লা গলির বাড়ি থেকে নানি ও দুই নাতি-নাতনির লাশ উদ্ধার করেছিল পুলিশ। নিহতরা হলেন- মহিদুন্নেছা (৫৫), তার নাতি মোস্তাকিম (৮) ও নাতনি ফাতিহা (৬)। শিশু দুটি শেফার আহমেদ ও রুবি আক্তার দম্পতির সন্তান। মা-বাবার মধ্যে একজন রামপালে আরেকজন চেম্বার অব কমার্সে চাকরি করেন। সকালে তারা সন্তান দুটিকে নানির কাছে রেখে কাজে বের হন। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে কাউকে না পেয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু করেন। পরে মুরগির খামারের ভেতর তিন জনের লাশ পড়ে থাকতে দেখে পুলিশে খবর দেন। পুলিশ লাশ উদ্ধার করে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠায়। তাদের সবার শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে বলে শুরুতেই জানিয়েছিলেন চিকিৎসক ও পুলিশ।
প্রেস ব্রিফিংয়ে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার আবু রায়হান বলেন, ‘গত ১৮ নভেম্বর লবণচরা থানায় হত্যা মামলা করেন নিহত দুই শিশুর বাবা। হত্যার মূলহোতা শামীম আহমেদকে গত বুধবার রাতে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে লবণচরা থানায় হস্তান্তর করা হয়। শুক্রবার আদালতে হাজির করলে হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দেয়। এর মধ্য দিয়ে হত্যার রহস্য উন্মোচন হয়।’
জবানবন্দির বরাত দিয়ে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার বলেন, ‘জমি সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে খুনি ভাড়া করে হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছিল। হত্যায় সাত জন অংশ নেয়। তাদের মধ্যে দুজন বাড়ির বাইরে ছিল এবং পাঁচ জন ঘরে ঢুকে সরাসরি হত্যায় অংশ নেয়। ইট দিয়ে মাথায় আঘাত করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় শামীদের দুই সহযোগীকে গ্রেফতার করা হয়েছে, বাকিদের ধরতে পুলিশের অভিযান চলছে।’
যে কারণে হত্যার পরিকল্পনা
অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার বলেন, ‘রূপসা উপজেলার আইচগাতী ইউনিয়নের ভবানীপুর গ্রামে ১ একর ৬৯ শতক পৈতৃক জমি নিয়ে শেফার আহমেদের সঙ্গে তার মামাতো ভাই শামীমের বিরোধ চলছিল। এ নিয়ে আদালতে মামলাও চলছে। ২০০৩ সালে শামীম একটি অস্ত্র মামলার আসামি ছিল। এরপর ফ্রান্সে চলে যায়। ২০১৭ সালে ফ্রান্স থেকে দেশে ফেরে। অস্ত্র মামলায় গ্রেফতার হওয়ার পর সাত মাস আগে জামিনে মুক্তি পায়। তবে জেলে একটি সন্ত্রাসী গ্রুপের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে তার। সেখানে বসেই শামীম তার ফুফাতো ভাই শেফারের পরিবারকে হত্যার পরিকল্পনা করে। জেল থেকে বেরিয়ে ওসব সন্ত্রাসীকে এক লাখ টাকায় ভাড়া করে শেফারের পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য। ১৬ নভেম্বর দুপুর একটা থেকে দেড়টার মধ্যে শামীমের নেতৃত্বে সাত জন শেফারের বাড়িতে যায়। প্রথমে দেয়াল টপকে একজন ভেতরে প্রবেশ করে প্রধান গেটের পকেট গেট খুলে দেয়। এরপর বাকিরা ভেতরে ঢুকে একে একে তিন জনকে ইট দিয়ে থেঁতলে হত্যা করে মুরগির খামারের ভেতরে রেখে দেয়। শেফার ও তার স্ত্রীকে হত্যার জন্য ওই বাড়িতেই অবস্থান করেছিল। পরে নানিসহ দুই নাতি-নাতনিকে দীর্ঘ সময়ে না দেখে আশপাশের লোকজন চলে আসায় কৌশলে পালিয়ে যায় তারা।’
অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার আরও বলেন, ‘হত্যার পরিকল্পনাকারী শামীম ঘটনার দিন থেকে পলাতক ছিল। কৌশলে ফ্রান্সে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। গত বুধবার রাত ৩টার দিকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। সে রূপসা থানার রুস্তম আলীর ছেলে। পরদিন এ ঘটনায় লবণচরার মোল্লাপাড়া এলাকার আজহারুল ইসলামের ছেলে তরিকুল ইসলাম তারেককে (২৬) গ্রেফতার করা হয়। তার বিরুদ্ধে একটি মাদকের মামলা আছে। একই দিন ওই থানার জিন্নাহপাড়া এলাকার মো. বাবুল হাওলাদারের ছেলে তাফসির হাওলাদারকে (২০) গ্রেফতার করা হয়। তার বিরুদ্ধে চুরি ও ছিনতাইয়ের দুটি মামলা রয়েছে। তাদের মধ্যে শামীম শুক্রবার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে জানায়, হত্যাকাণ্ডের পর ভাড়াটে খুনিদের এক লাখ টাকা পরিশোধ করেছিল। ওই দিনই তাদের কারাগারে পাঠানো হয়।’
প্রেস ব্রিফিংয়ে কেএমপির সহকারী পুলিশ কমিশনার (খুলনা জোন) মো. শিহাব করিম, সহকারী পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) ত.ম রোকনুজ্জামান, সহকারী পুলিশ কমিশনার মো. গোলাম মোর্শেদ, লবণচরা থানার ওসি হাওলাদার সানওয়ার হুসাইন মাসুম ও নিহত দুই শিশুর বাবা-মা উপস্থিত ছিলেন।
















