রাজশাহী মহানগরীর জন্য বর্জ্য ফেলার একমাত্র স্থান নওদাপাড়ার সিটিহাট এলাকা। পশুহাটের ওপরে গড়ে উঠেছে গৃহস্থালি বর্জ্যের পাহাড়। রবিবার ও বুধবার হাট বসে এখানে। বর্জ্যের ভেতরেই কেনাবেচা চলছে এ হাটে। তবে বর্জ্য ফেলার এই স্থানগুলো ধারণক্ষমতা ছাড়িয়ে গেছে। এখন ফেলা হচ্ছে মহাসড়কে। মহাসড়কে ফেলার কারণে স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
রাজশাহী সিটি করপোরেশন বর্জ্য ফেলার স্থানটি ২০০৪ সালে তৈরি করে। এর ঠিক সামনে দিয়ে ৬ নম্বর জাতীয় মহাসড়ক। এই সড়ক শেষ হয়েছে সোনামসজিদ বন্দরে। এই মহাসড়ক দিয়ে প্রতিদিন শত শত ট্রাক চলাচল করে। সিটি বাইপাস সড়ক বন্ধ থাকার কারণে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আসা সকল বাসও এই সড়ক ব্যবহার করছে। এ ছাড়াও সিটিহাট বসে দুই দিন। দুই দিনে বিভিন্ন ধরনের গাড়ি ও মানুষ উপস্থিত হচ্ছে সেখানে।
জানা গেছে, সিটিহাটের ঠিক পাশেই বর্জ্যের স্তূপ জমে আছে। সেখানে ধারণক্ষমতা শেষ হওয়ার কারণে বর্জ্য ফেলা হচ্ছে মহাসড়কে। আবার কৃষিজমিতেও ফেলা হচ্ছে বর্জ্য। সেখানকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনেও ফেলা হচ্ছে। তবে বর্জ্য ফেলার কাজে যারা নিয়োজিত তারা বলছেন, ‘বর্জ্য ফেলার স্থান ভরে যাওয়ার কারণে আমাদের বাধ্য হয়ে সড়কের পাশে ফেলতে হচ্ছে।’
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের পরিছন্নতাকর্মীরা প্রথমে নগরীর বাড়িঘর থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করেন। এরপর নগরীর বিভিন্ন স্থানে থাকা ১৯টি সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশনে এবং খোলা জায়গায় ফেলা হয়। যেখান থেকে ট্রাক ও ট্রাক্টরের মাধ্যমে নওদাপাড়ায় নিয়ে যাওয়া হয়।
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন প্রায় নগরী থেকে সাড়ে চারশ টন বর্জ্য সেখানে নিয়ে গিয়ে ফেলা হচ্ছে।
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রধান পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা শেখ মো. মামুন ওরফে ডলার বলেন, ‘নওদাপাড়ায় আমাদের বিদ্যমান ল্যান্ডফিলটি দুই-তিন বছর আগে ধারণক্ষমতা ছাড়িয়ে গেছে। আমরা সম্প্রতি একটি নতুন ল্যান্ডফিল স্থাপনের অনুমতির জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব দিয়েছি। নতুন ল্যান্ডফিলটি কার্যকর করতে দুই বছর বা তার বেশি সময় লাগতে পারে। মন্ত্রণালয় এবং অন্যান্য কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের পাশাপাশি জমির অভিযোগও জড়িত ছিল। পরিকল্পনা করছি কীভাবে আমরা বর্তমান ল্যান্ডফিলে বর্জ্য ফেলতে পারি।’
উত্তর নওদাপাড়ার বাসিন্দা আবদুল হাদী বলেন, ‘যেখানে ময়লা ফেলা হচ্ছে তার ১০ গজের মধ্যে বেশকিছু বাসাবাড়ি আছে। এখানে মানুষজন বসবাস করে। আমার বাড়িও সড়কের কাছে। ২৪ ঘণ্টা বাড়ির জানালা বন্ধ করে রাখতে হচ্ছে। অসহ্য দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। মশা-মাছিও বাড়িতে আসছে। সিটি করপোরেশনকে দ্রুত এর ব্যবস্থা নিতে হবে।’
রাজশাহী রেসিডেনসিয়াল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মাহবুবুল আহসান বলেন, ‘রাজশাহী সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা কলেজের সামনে বর্জ্য ফেলে যাচ্ছেন। এমনকি কলেজের গেটের সামনে ফেলে রেখে যাচ্ছে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় কলেজের গেটে আবর্জনার স্তূপ হয়ে আছে। শিক্ষার্থীরাও এ কারণে ক্লাসে উপস্থিত হতে দুর্গন্ধের মুখে পড়ছে।’
রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মুখপাত্র শংকর কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘খোলা স্থানে বর্জ্য ফেলার কারণে মাছি ও মশা জীবাণু বহন করছে। এতে কলেরা, ডেঙ্গু, ত্বকের সংক্রমণ এবং শ্বাসকষ্টের ঝুঁকি থাকছে। চিকিৎসা বর্জ্য, কসাইখানার বর্জ্যও এই স্থানে ফেলা হচ্ছে। যা বিপজ্জনক সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে।’
পরিবেশবাদীরা বিষয়টিকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ব্যর্থতা এবং পদ্ধতিগত অবহেলা হিসেবে দেখছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিজ্ঞানের অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, ‘বারনই ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক থেকে মাটি, ভূপৃষ্ঠের জল বর্জ্য পদার্থ পরীক্ষা করা হয়েছে। বারনই নদীতে বর্জ্য পানি বহন করে এবং সবচেয়ে বেশি দূষিত হচ্ছে নদীটি। যেসব কৃষিজমিতে বর্জ্য ফেলা হচ্ছে তাতে শিশুরা তীব্র বিষক্রিয়ার ঝুঁকিতে থাকে।’
রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক এমদাদুল হক বলেন, ‘মোট কঠিন বর্জ্যের ৭১ শতাংশেরও বেশি খাদ্য ও উদ্ভিজ্জ বর্জ্য। বিভিন্ন বর্জ্য থেকে শক্তি প্রযুক্তির মাধ্যমে শক্তিতে রূপান্তরিত করা যেতে পারে। ৩৫৮ দশমিক ১৯ টন কঠিন বর্জ্য থেকে আনুমানিক ১৫৯ দশমিক ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যেতে পারে।’