রংপুরের তারাগঞ্জে চোর সন্দেহে দুজনকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। শনিবার (৯ আগস্ট) রাতে উপজেলার সয়ার ইউনিয়নের বুড়িরহাট এলাকায় ঘটনাটি ঘটে। স্বজনদের অভিযোগ, পরিকল্পিতভাবে মব বানিয়ে তাদের হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় অভিযুক্তদের বিচার দাবি করেছেন তারা।
পুলিশ ও স্বজনরা জানান, নিহত রূপলাল দাসের (৪৫) বাড়ি তারাগঞ্জ উপজেলার কুর্শা ইউনিয়নের ঘনিরামপুর বেলতলী বুড়িরহাট এলাকায়। তিনি বুড়িরহাট বাজারে মুচির কাজ করতেন। অপরদিকে রূপলালের ভাগনি জামাই প্রদীপ দাস (৩৫) মিঠাপুকুর উপজেলার গোপালপুর ছড়ান গ্রামের বাসিন্দা। মুচির কাজ ছাড়াও তিনি রিকশা-ভ্যান চালাতেন।
নিহত রূপলালের চাচা রামনাথ দাস জানান, রূপলালের মেয়ে নুপুর স্থানীয় বিদ্যালয় থেকে এবার এসএসসি পাস করেছে। সে তার মেয়ের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর পৌর এলাকার জনৈক কমল নামে এক যুবকের বিয়ের ব্যাপারে কথাবার্তা চলছিল। দিন-তারিখ ঠিক করার জন্য রূপলাল তার ভাগনি জামাই প্রদীপকে ডেকে পাঠায়। খবর পেয়ে মিঠাপুকুর থেকে নিজের ভ্যান চালিয়ে শ্বশুর রূপলালের বাড়ির উদ্দেশে রওনা হন প্রদীপ।
এদিকে, বিয়ের অনুষ্ঠানে ব্যবহারের জন্য সামাজিক রীতির অংশ হিসেবে শনিবার সৈয়দপুরের একটি ভাটিখানা থেকে স্পিড ড্রিংকের বোতলে বাংলা মদ সংগ্রহ করে প্রদীপ ও রূপলাল বাসায় ফিরছিলেন। রাত ৮টার দিকে সয়ার ইউনিয়নের ফরিদাবাদ মোড়সংলগ্ন বটতলা এলাকায় পৌঁছালে স্থানীয় কয়েকজন যুবক তাদের ব্যাগে থাকা মদ দেখতে পান। একপর্যায়ে তারা চোর চোর বলে চিৎকার করতে থাকলে মুহূর্তেই লোকজন জড়ো হয়ে কোনও কথা না শুনে দুজনকে বেধড়ক মারধর শুরু করে। ফলে রূপলাল ঘটনাস্থলেই মারা যান। গুরুতর আহত হয় প্রদীপ। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে নিহত রূপলাল ও আহত প্রদীপকে উদ্ধার করে তারাগঞ্জ হাসপাতালে নিয়ে আসে। সেখানে প্রদীপের অবস্থার অবনতি হলে তাকে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। পুলিশ নিহত দুজনের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য রবিবার (১০ আগস্ট) বিকাল ৩টায় রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে প্রেরণ করে।
এদিকে রূপলাল নিহত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে তার বাড়িতে শোকের ছায়া নেমে আসে। স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে বাতাস।
সরেজমিন রবিবার দুপুরে নিহত রূপলালের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তার ১০ বছর বয়সী মেয়ে রুপা দাস ও ১৩ বছর বয়সী ছেলে জয় দাসকে জড়িয়ে বারবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলছিলেন তার স্ত্রী ভারতী দাস। তার বুকফাটা আর্তনাদ সেখানে শোকাবহ অবস্থার সৃষ্টি করেছে।
রূপলালের স্ত্রী ভারতী দাস বলেন, ‘আমার স্বামীকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে আমার ভাগনি জামাই প্রদীপকেও হত্যা করা হয়েছে। দেশে কোনও আইন আছে? একজন নিরপরাধ মানুষকে এভাবে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো। সেইসঙ্গে ভাগনি জামাই প্রদীপকেও মেরে ফেলা হলো কিন্তু কেউই তাদের বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি।’ তিনি তার স্বামী ও ভাগনি জামাইকে হত্যার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতারের দাবি জানান।
বিয়ে ঠিক হওয়া বড় মেয়ে নুপুর দাস (১৮) মা ভারতী দাসের গলা ধরে হাউমাউ করে কাঁদছিল। এ সময় তার আহাজারিতে অনেকেই তাদের অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি। কেঁদে কেঁদে নুপুর বলছিল, ‘আমাদের এতিম করে দেওয়া হলো। অন্যায়ভাবে দুজন নিরপরাধ মানুষকে এভাবে নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যা করার কি বিচার আমরা পাবো? সরকার কি আমাদের নিরাপত্তা দিতে পারলো? আমরা এর কঠিন বিচার চাই।’
এদিকে ছেলেকে হারিয়ে রূপলালের বৃদ্ধা মা লালিচা দাস কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। প্রতিবেশীরা তার মুখ ও মাথায় পানি ঢেলে জ্ঞান ফেরান। তিনি তার ছেলে রূপলাল ও প্রদীপ হত্যাকারীদের বিচার দাবি করে বলেন, ‘আমাদের সংসার কে চালাবে? রূপলাল যা রোজগার করতো তা দিয়ে কোনোরকমে আমাদের সংসার চলতো। এখন কীভাবে সংসার চলবে? ছেলে-মেয়েদের কে দেখবে?’ এসব বলছিলেন আর জ্ঞান হারিয়ে ফেলছিলেন।
এদিকে, বিকাল ৩টার দিকে অ্যাম্বুলেন্সে করে নিহত রূপলাল ও প্রদীপের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য রংপুর মেডিক্যাল কলেজের মর্গে আনা হয়। সেখানে তারাগঞ্জ থানা পুলিশের কয়েকজন সদস্য সঙ্গে এলেও তারা কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি।
তবে মরদেহের সঙ্গে এসেছেন রূপলালের ভাতিজা রনি দাস ও সরেন দাস। তারা জানান, রাতে খবর পেয়েছেন যে রুপলাল নিহত হয়েছেন। রবিবার ভোরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় প্রদীপও মারা গেছে। তাদের চোর বানিয়ে পরিকল্পিতভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। অথচ তারা চোর নয়, মুচির কাজ করতেন। এ ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত সকলকে আইনের আওতায় আনার দাবি তাদের।
সার্বিক বিষয়ে জানতে তারাগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এম এ ফারুকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, নিহতদের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনায় মামলা দায়ের করার প্রস্তুতি চলছে। তবে কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি বলে জানান তিনি।

















