ময়মনসিংহের তারাকান্দায় হিজবুল আলম জিয়েস নামে এক ছাত্রদল নেতার ‘টর্চার সেলের’ সন্ধান মিলেছে। সেই সেলে সাধারণ মানুষকে ধরে এনে গান বাজিয়ে নির্যাতনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। হিজবুল আলম (২৬) উপজেলার বানিহালা ইউনিয়ন ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক।
এ ঘটনায় প্রতিবাদ করতে গিয়ে তার নির্যাতনের শিকার হয়ে তারাকান্দা থানায় মামলা করেছেন মহানগর ছাত্রদলের সাবেক সহ-সাধারণ সম্পাদক মামুন সরকার। পরে জিয়েস ও তার দুই সহযোগীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। সোমবার পৃথক সময়ে বানিহালা ইউনিয়নের পৃথক এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়।
জিয়েস বানিহালা ইউনিয়নের মাঝিয়ালি গ্রামের মঞ্জুরুল ইসলামের ছেলে ও একই ইউনিয়ন ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক। তবে তাকে দলীয় পদ থেকে সাময়িকভাবে অব্যাহতি দিয়েছে ময়মনসিংহ জেলা উত্তর ছাত্রদল। গতকাল রাতে এ সংক্রান্ত একটি চিঠি প্রকাশিত হয়। এর আগে সোমবার ভোরে জিয়েসের দুই সহযোগী রাফি (১৯) ও আবদুল্লাহকে (২০) গ্রেফতার করে পুলিশ।
মামুন সরকার জানান, ৮ আগস্ট মাঝিয়ালি বাজারে এক দোকানদারের কাছে পাঁচ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেন জিয়েস। একপর্যায়ে ওই দোকানিকে মারধর করে তার দোকান বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে দোকানটি খোলার ব্যবস্থা করে দেন মামুন। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে পরদিন (৯ আগস্ট) মামুনকে মারধর করেন জিয়েস। এ ঘটনায় গতকাল তারাকান্দা থানায় মামুন বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। এতে জিয়েসসহ অজ্ঞাতনামা চার-পাঁচ জনকে আসামি করা হয়। ওই মামলায় অভিযান চালিয়ে গতকাল ভোরে রাফি ও আবদুল্লাহ এবং রাত ৯টার দিকে জিয়েসকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় জিয়েসের টর্চার সেলে অভিযান চালিয়ে নির্যাতনের বিভিন্ন দেশি সামগ্রী ও নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প উদ্ধার করে পুলিশ। মামলা ও গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তারাকান্দা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) লিটন চন্দ্র পাল।
পুলিশ ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় জিয়েসের কোনও তৎপরতা দেখা না গেলেও গত বছরের আগস্টের পর বানিহালা ইউনিয়নে ব্যাপকভাবে আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করেন। মাঝিয়ালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে নিজের একটি মাছের খামারে টর্চার সেল তৈরি করেন। সেখানে দেশি অস্ত্র প্রদর্শন ও আটক ব্যক্তিদের মারধরের ভিডিও সম্প্রতি ফেসবুকে ভাইরাল হয়। ওই সেলে বিভিন্ন জনকে আটকে রেখে মোবাইলে ভিডিও করে কিংবা নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর রাখতেন। নির্যাতনের পর তাদের কাছে স্বীকারোক্তি নিতেন যে তারা জিয়েসের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন। এভাবে চাঁদাবাজি করতেন।
ময়মনসিংহ উত্তর জেলা ছাত্রদলের দফতর সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘ছাত্রদলের ওই নেতার সম্পর্কে বিভিন্ন অপকর্মের অভিযোগ শুনেছি। ওই অবস্থায় তাকে সাময়িকভাবে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।’
দলীয় সূত্রে জানা যায়, ২০২১ সালের ২৯ ডিসেম্বর থেকে হিজবুল আলম জিয়েস বানিহালা ইউনিয়ন ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে রয়েছেন।
মৎস্য খামারে ‘টর্চার সেল’
স্থানীয় বাসিন্দা ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারাকান্দা উপজেলার মাঝিয়ালি গ্রামে একটি মৎস্য খামার আছে জিয়েসের। সেই খামারের ছোট একটি ঘরকে টর্চার সেল বানিয়ে গান বাজিয়ে মানুষকে নির্যাতন করতেন। সম্প্রতি সেখানে স্থানীয় তিন বাসিন্দাকে আটকে মারধরের ঘটনা ঘটে। পরে সেই ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে।
তার হাতে মারধরের শিকার হন মাঝিয়ালি গ্রামের বাসিন্দা মামুন সরকার। স্থানীয় বাজারে চাঁদার জন্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার প্রতিবাদ করায় তার হামলার শিকার হন। এ ঘটনায় বাদী হয়ে সোমবার থানায় মামলা করেন। মামলার এজাহারে উল্লেখ করেছেন, জিয়েস এলাকার চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী, মাদক সেবনকারী ও চাঁদাবাজ। তিনি মাঝিয়ালি বাজারে বিভিন্ন দোকানদারের কাছ থেকে মালামাল নেওয়ার পর টাকা দেন না। ৮ আগস্ট হিজবুল স্থানীয় বাজারে হক মিয়ার সেলুনে চুল কাটিয়ে বিল দেননি। টাকা চাইলে উল্টো পাঁচ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেন। একপর্যায়ে হক মিয়া ও তার বড় ভাই লাক মিয়াকে মারধর করে দোকানে তালা লাগিয়ে দেন। বিষয়টি মামুনকে জানালে তিনি দোকান খুলে ব্যবসা করতে বলেন। পরদিন ৯ আগস্ট দোকানটি খোলা পেয়ে জিয়েস ‘টাকা না দিয়া কার কথায় দোকান খুলছস’ বলে হক মিয়াকে মারধর করেন। তাকে রক্ষা করতে গিয়ে মামুন সরকারও মারধরের শিকার হন।
যা বলছেন ভুক্তভোগীরা
মামুন সরকার বলেন, ‘ছাত্রদলের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থেকে কেউ এ ধরনের চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা করবেন; তা হতে পারে না। আমি সাংগঠনিক ও আইনগতভাবে কঠোর বিচার চাই। আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি, এলাকার যদি কেউ বলেন এই ছেলে অপরাধী নন, মাদক ব্যবসায়ী নন, তাহলে আমার কোনও অভিযোগ থাকবে না, আমি মামলা তুলে নেবো। তিনি এলাকায় একটি টর্চার সেল করেছেন। বিভিন্ন এলাকা থেকে লোক এনে এখানে নির্মম নির্যাতন করেন। গ্রামপর্যায়ে টর্চার সেল নিয়ে এসেছেন, এটি মানা যায় না।’
মারধরের শিকার দোকানি হক মিয়া বলেন, ‘চুল কাটার পর পাঁচ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেন জিয়েস। টাকা না দিলে মারধর করে দোকান থেকে বের করে তালা লাগিয়ে দেন। পরে মামুন ভাইয়ের কথায় দোকান খুললে পুনরায় হামলা করে এবং মামুন ভাইকেও মারধর করেন।’
ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, টর্চার সেলে মোবাইলে হিন্দি-বাংলা গান ছেড়ে ওই এলাকার দিনমজুর রাসেল মিয়া (২৮) ও জুয়েল মিয়াকে (২৭) মারধর করছেন জিয়েস। তার হাতে দেশি একধরনের বিশেষ অস্ত্র দেখিয়ে সঙ্গে থাকা অন্যজনকে মারতে বলেন। পরে সঙ্গে থাকা সেই যুবক মারতে থাকেন।
রাসেল মিয়া বলেন, ‘ঘটনাটি অন্তত ২০ দিন আগের। ওই দিন টর্চার সেলে বিকাল ৫টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত আমাদের তিন জনকে আটকে রেখে মারধর করেন জিয়েস। সেদিন আমাকে ফোন দিয়ে নিয়ে আটকে মারধর করে। আমার কাছে ৪০ হাজার টাকা চাঁদা চেয়ে মারধর করে, সেটির ভিডিও করতে চায়। পরে আমি ১০ হাজার টাকা দেওয়ার কথায় রাজি হয়ে সেখান থেকে মুক্তি পাই। মারধর করে পাঠিয়ে দেওয়ার সময় কাউকে কিছু না বলতে বলে দেয়। আমাদের কেন আটকে মারধর করলো, আমরা এর বিচার চাই।’
নির্যাতনের শিকার জুয়েল বলেন, ‘জিয়েস দলীয় প্রভাব খাটিয়ে আমাদের কাছে টাকা পাবে মর্মে মারধর করে ভিডিও স্বীকারোক্তি আদায় করে চাঁদাবাজি করেন। মেরে ফেলবে এমন ভয়ে আমরা স্বীকারোক্তি দিই।’
দলীয় নেতারা বলছেন এসব অপকর্ম সমর্থন করেন না
বানিহালা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ও স্থানীয় ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মকবুল হোসেন বলেন, ‘জিয়েসের টর্চার সেল আছে। সেখানে মানুষকে আটকে মারধর করার ভিডিও দেখেছি। ইউনিয়ন ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক বললেও আমরা তাকে কোনও কর্মকাণ্ডে পাইনি। আমরা এ অপকর্ম সমর্থন করি না।’
ইউনিয়ন যুবদলের কর্মী মোজাম্মেল সরকার বলেন, ভিডিওতে যা দেখা গেছে, তা ভয়াবহ। মধ্যযুগীয় কায়দায় গান বাজিয়ে ঘরে আটকে মারধর করে। পুলিশ ‘টর্চার সেলের’ তালা ভেঙে ভেতর থেকে মারধরের সরঞ্জাম ও বিভিন্ন ধরনের স্ট্যাম্প পেয়েছে। মানুষকে এখানে ধরে এনে জিম্মি করে বিভিন্ন অঙ্কের টাকা বসিয়ে স্বাক্ষর রাখতো জিয়েস। যার কাছে চাঁদা চাইতো, না দিলেই মারধর করতো, কাউকে মানতো না। এলাকার সবাই তার নির্যাতনের শিকার, কেউ ভয়ে মুখ খোলেননি এতদিন।
স্থানীয় ইউপি সদস্য আবু তাহের বলেন, ‘জিয়েস সবসময় নেশার মধ্যে থাকে। বিভিন্ন সময় আমাকেও মারধরের হুমকি দিয়েছে। তার টর্চার সেল আছে। এসব ঘটনায় তার ও সহযোগীদের বিচার চাই আমরা।’
টর্চার সেল থেকে দেশি অস্ত্র ও সরঞ্জাম এবং নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প উদ্ধার
তারাকান্দা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) লিটন চন্দ্র পালের নেতৃত্বে জিয়েসের টর্চার সেলে মঙ্গলবার ভোরে অভিযান চালায় পুলিশ। সেখানে মানুষকে মারধরের দেশি সরঞ্জাম ও নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প পেয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছেন লিটন চন্দ্র।
তারাকান্দা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ টিপু সুলতান বলেন, ‘টর্চার সেলে নির্যাতন ও চাঁদাবাজির ঘটনায় মামলা হয়েছে। ঘটনায় জড়িত ছাত্রদল নেতা ও তার দুই সহযোগীকে গ্রেফতার করে আদালতের মাধ্যমে মঙ্গলবার বিকালে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনায় আরও কেউ জড়িত আছে কিনা, তদন্ত করে দেখছি আমরা।’