নিখোঁজ থাকা সাংবাদিক ও লেখক বিভুরঞ্জন সরকারের লাশ উদ্ধারের পর তার মৃত্যু নিয়ে নানান রহস্য তৈরি হয়েছে। নিহতের শরীরে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে পুলিশ। এ ছাড়া তিনি নিখোঁজ হওয়ার আগ পর্যন্ত স্বাভাবিক আচরণ করেছেন বলে জানিয়েছেন নিহতের স্বজনরা। তবে নিখোঁজের আগে তিনি ফুটনোটে নানান ইঙ্গিত দিয়ে অনেক কথা লিখেছেন। এসব কিছু মিলিয়ে তার মৃত্যু বেশ রহস্য তৈরি করেছে।
শুক্রবার (২২ আগস্ট) বিকালে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় মেঘনা নদী থেকে তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পরে নিহতের স্বজনরা এসে তার লাশ শনাক্ত করে। লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে রাখা হয়েছে।
এ বিষয়ে নিহত সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকারের ছোট ভাই চির রঞ্জন সরকার বলেন, আমার দাদা গতকাল সকালে অফিসে যাওয়ার কথা বলে তার বাসা থেকে বের হয়। সে তার মোবাইল ফোন বন্ধ করে বাড়িতে রেখে গেছেন। যে কারণে আমার বৌদি তাকে ফোন করে পায়নি। পরে অফিসে ফোন করেও তাকে পায়নি। এরপর থেকে আমরা উদ্বিগ্ন ছিলাম। সব আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেও তার খোঁজ পাইনি। পরে এ ঘটনায় গতকাল রাতে রমনা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছি। আজ আমরা নানাভাবে তার খোঁজ করেছি। আজ বিকালে থানার ওসির মাধ্যমে খবর পাই মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় একজনের মৃতদেহ পাওয়া গেছে। পরে ভিডিও ও ছবি দেখে তার লাশ শনাক্ত করি। এমন ঘটনা কীভাবে ঘটলো আমরা কিছু জানি না। এটা কী খুন, আত্মহত্যা নাকি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড তা আমরা জানি না। এমন পরিণতি যেন কারও না হয়।
তিনি আরও বলেন, আমার দাদার দুই সন্তান। আমার ভাতিজির ঘরে একটা সন্তান রয়েছে। আমার দাদা নাতির সঙ্গে অনেক কথা বলতো। এ ছাড়া তিনি পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে কম কথা বলতেন।
নিহতের ছেলে হৃদ রঞ্জন সরকার বলেন, সকালে তিনি (বাবা) স্নান করে ও নাশতা করে বাড়ি থেকে বের হয়েছেন। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় তিনি একেবারে স্বাভাবিক ছিলেন। তিনি নিয়মিত ইনস্যুলিন নিতেন, সেটাও নিয়ে বের হয়েছেন। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় মাকে বলে যান বিকাল ৫টা থেকে সাড়ে ৫টার সময় বাড়ি ফিরবেন। স্বাভাবিকভাবে ওই সময় তিনি নিয়মিত বাড়ি ফেরেন। তবে তিনি ফোন বাড়িতে রেখে যাওয়ার বিষয়ে খুব একটা উদ্বিগ্ন ছিলাম না। কারণ তিনি প্রায় সময় ফোন বাড়িতে রেখে যেতেন।
এ বিষয়ে কলাগাছিয়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ সালেহ আহমেদ পাঠান বলেন, লাশ উদ্ধারের পর নিহতের পরিবারের স্বজনদের খবর দেওয়া হয়। এরপর স্বজনরা এসে সাংবাদিকের লাশ শনাক্ত করেন। তার শরীরের উপরিভাগে কোনও আঘাতের চিহ্ন নেই। ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হলে আঘাতের বিষয়টি ও মৃত্যুর কারণ বলা সম্ভব হবে। সে অনুযায়ী আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এর আগে ২১ আগস্ট সকাল সোয়া ৯টায় বিভুরঞ্জন সরকার একটি লেখা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে মেইল করেন। ফুটনোটে তিনি লেখেন, “জীবনের শেষ লেখা হিসেবে এটা ছাপতে পারেন।”
পরিবারের সদস্যরা জানান, ওই দিন ১০টার দিকে অফিসে যাওয়ার কথা বলে বাসা থেকে বেরিয়ে তিনি আর ফেরেননি। তার নিখোঁজ থাকার কথা জানিয়ে বৃহস্পতিবার (২১ আগস্ট) রাতে থানায় জিডি করেছে তার পরিবার।
সিনিয়র সাংবাদিক, কলাম লেখক বিভুরঞ্জন সরকার স্কুলছাত্র থাকা অবস্থায় সাংবাদিকতা পেশায় জড়ান। একইসঙ্গে তিনি বাম রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হন।
পঞ্চগড়ে থাকতে তিনি দৈনিক আজাদের প্রতিনিধি ছিলেন। এরপর ঢাকায় সাপ্তাহিক একতা, দৈনিক রূপালীতে কাজ করেন। নিজে সম্পাদনা করেছেন সাপ্তাহিক ‘চলতিপত্র’। একসময় ‘মৃদুভাষণ’ নামে সাপ্তাহিকের নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন। ‘দৈনিক মাতৃভূমি’র সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেছেন। দেশের প্রায় সব দৈনিক এবং অনলাইনে নিয়মিত কলাম লিখতেন তিনি।
আশির দশকজুড়ে তিনি সাপ্তাহিক যায়যায়দিনের সহকারী সম্পাদক পদে থাকাকালে ‘তারিখ ইব্রাহিম’ ছদ্মনামে লিখে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন।
সর্বশেষ তিনি দৈনিক আজকের পত্রিকার জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
বিভুরঞ্জন সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। তবে পেশার কারণে তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না।