দর্শক ও চলচ্চিত্র সংকটে আবারও অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হলো বগুড়ার ‘মধুবন সিনেপ্লেক্স’। লোকসানের কারণে সিনেমা হলটি বন্ধ ঘোষণা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মালিক আর এম ইউনুস রুবেল। শনিবার (২০ সেপ্টেম্বর) দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে তথ্য জানিয়েছেন তিনি।
এ খবরে বিনোদনপ্রেমীদের মাঝে হতাশা দেখা দিয়েছে। বিনোদনপ্রেমীরা বলছেন, বগুড়া জেলাজুড়ে একসময় সিনেমা হলের সংখ্যা ছিল ৩৮টি। তবে জেলাটি সিনেমার সেই জৌলুশ হারিয়েছে অনেক দিন। ভাঙা পড়েছে ৩১টি হল। শহরে দুটিসহ পুরো জেলায় মোটে সাতটি হল টিকে আছে। শুধু জেলা শহরেই একসময় ১০টি প্রেক্ষাগৃহ ছিল। সবশেষ শহরে চালু ছিল মধুবন সিনেপ্লেক্স ও সোনিয়া হল।
একে একে বন্ধ হয়ে গেছে শহরের সাতমাথায় অবস্থিত মাধু ও মেট্রো সিনেমা, মেরিনা টকিজ, কবি নজরুল ইসলাম সড়কে উত্তরা টকিজ, চারমাথায় বীথি সিনেমা, জাহাঙ্গীরাবাদ ক্যান্টনমেন্টে সেনা অডিটরিয়াম, মাঝিরা ক্যান্টনমেন্টে উল্লাস সিনেমা হল, চক সূত্রাপুর মাসুম সিনেমা হল এবং বনানী সিনেমা হল। সর্বশেষ বন্ধ হয়েছে বাম্বি সিনেমা হল। মাধু, মেট্রো ও মেরিনা ভেঙে বহুতল শপিং সেন্টার নির্মাণ করা হয়েছে। উত্তরা সিনেমা হলের জায়গাটি বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক সংগঠন ও প্রভাবশালী ব্যক্তি দখল করেছে। শহরে দুটিসহ পুরো জেলায় এখন মোট সাতটি সিনেমা হল টিকে আছে।
মধুবন সিনেপ্লেক্সের মালিক আর এম ইউনুস রুবেল বলেন, কর্মচারীদের বেতন, বিদ্যুৎ বিল, রক্ষণাবেক্ষণে গড়ে প্রতি মাসে খরচ দুই লাখ টাকা। গত ঈদুল আজহায় শাকিব খান অভিনীত ‘তান্ডব’ সিনেমার পর ভালো ছবি না থাকায় দর্শক নেই। ধুঁকে ধুঁকে চলছিল সিনেপ্লেক্সটি। ছবি চালিয়েও খরচ ওঠেনি। বিদ্যুৎ বিল বকেয়া। ঋণ করে কর্মচারীদের বেতন শোধ করতে হয়েছে। এভাবে মাসের পর মাস লোকসান গুনতে গুনতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। বাধ্য হয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য মধুবন সিনেপ্লেক্স বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। নির্বাচিত সরকার না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন। এরপর নির্বাচিত সরকার বিদেশি সিনেমা আমদানির উদ্যোগ নিলে চালু করবেন।
প্রেক্ষাগৃহ সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ২০২১ সালের ১৫ অক্টোবর ‘বাজি’ সিনেমা প্রদর্শনের মাধ্যমে নতুন আঙ্গিকে যাত্রা শুরু করে মধুবন সিনেপ্লেক্স। ৩৩৬ আসন নিয়ে নতুন করে যাত্রা শুরু করা মধুবন রীতিমতো দর্শকজোয়ারে ভাসতে থাকে। প্রদর্শন ব্যবসায় রীতিমতো বাজিমাত করে ‘পরাণ’, ‘হাওয়া’, ‘প্রিয়তমা’, ‘তুফান’, ‘রাজকুমার’, ‘বরবাদ’ সিনেমা। ব্যবসাসফল হয়েছে হিন্দি সিনেমা ‘জওয়ান’ ও ‘পাঠান’। সবশেষ ‘তান্ডব’ সিনেমা প্রদর্শনকালে দর্শক সামাল দিতে নিয়মিত শো ছাড়াও মধ্যরাতে শো চালাতে হয়েছে। এরপর ভালো ছবি মুক্তি না পাওয়ায় দর্শকের অভাবে হলটির প্রদর্শন ব্যবসায় ছন্দপতন ঘটে।
আর এম ইউনুস রুবেল জানান, তার বাবা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট এ এম ইউনুস ১৯৭৪ সালে বগুড়া শহরের চেলোপাড়া এলাকায় প্রায় ২৪ শতক জমিতে মধুবন সিনেমা হল প্রতিষ্ঠা করেন। তখন হলের দর্শক ধারণক্ষমতা ছিল প্রায় এক হাজার। ১৯৭৪ সালের কোরবানির ঈদে যাত্রা শুরু করা মধুবন নানা চড়াই–উতরাই পেরিয়েছে। “ডাকু মনসুর” সিনেমা দিয়ে যাত্রা শুরু করা মধুবনে হাউসফুল চলেছে উত্তমকুমার ও মালা সিনহা অভিনীত “পৃথিবী আমারে চায়”, “গোপী গাইন বাঘা বাইন”, “সূর্যকন্যা”, “সীমানা পেরিয়ে”, “বসুন্ধরা”, “নাগ নাগীনি”, “লাইলী মজনু”, “রসের বাঈদানী”, “গোলাপী এখন ট্রেনে”, “সুজন সখী”সহ দর্শকনন্দিত বহু সিনেমা। এরপর নানা সংকটে ২০০৬ সালে মধুবন প্রথম বন্ধ হয়। ২০১৪ সালে মধুবন পুনরায় চালু হয়। ২০২১ সালে নতুন আঙ্গিকে যাত্রা শুরু করে মধুবন। এটি টিকিয়ে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা থাকবে। কারণ, এর প্রতিটি ইটের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমার বাবার হাতের ছোঁয়া, পরিবারের আবেগ ও অনুভূতি।
আর এম ইউনুস রুবেল বলেন, ‘পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করে প্রায় চার কোটি টাকা ব্যয়ে মধুবন সিনেপ্লেক্সে প্রতিষ্ঠার পর ২০২১ সালের ১৫ অক্টোবর প্রথম শো চালু করা হয়। দর্শক ধারণাক্ষমতা মোট ৩৫০ জন।
আধুনিকায়নের পর মধুবন সিনেপ্লেক্সে ভালো ব্যবসা করেছে জনপ্রিয় ‘পরাণ’, ‘হাওয়া’, ‘প্রিয়তমা’, ‘তুফান’ ও ‘বরবাদ’ সিনেমা। দূর-দূরান্ত থেকে দর্শকরা পরিবার-পরিজন নিয়ে সিনেমা উপভোগ করতে আসেন। সর্বশেষ ‘প্রিয়তমা’ ও ‘বরবাদ’ ছবির একাধিক মিডনাইট শোও চালানো হয়। এরপর ভালো ছবি মুক্তি না
পাওয়ায় দর্শকের অভাবে হলটির প্রদর্শন ব্যবসায় ছন্দপতন ঘটে। বর্তমানে দেশি সিনেমা ঈদ ছাড়া দর্শক টানতে পারছে না। বাংলায় ডাবিং করা বিদেশি সিনেমা চালাতে পারলে দর্শক আসার সম্ভবনা রয়েছে। কিন্তু আমদানি না থাকায় তা সম্ভব হচ্ছে না। প্রতিযোগিতায় দেশের ভালো সিনেমাও চলতো।’
গত কয়েক মাস ধরে মধুবন সিনেপ্লেক্স নিয়ে আমরা নানা সংকটের মুখোমুখি হয়েছি উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘যথেষ্ট মানসম্পন্ন সিনেমার অভাব, বিদেশি সিনেমা আমদানির জটিলতা, সরকার ও কর্তৃপক্ষের পর্যাপ্ত সহযোগিতা না পাওয়ায় হল চালানো ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়েছে। এসব সমস্যা নিয়ে সরকারের উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছি। চলতি সপ্তাহে ‘নন্দিনী’ ছবি চলছিল। কিন্তু দর্শক না পাওয়া খরচই ওঠেনি। ফলে লোকসানের মুখে মধুবন সিনেপ্লেক্স বন্ধ করে দিচ্ছি।’
পরিশেষে তিনি সিনেমা শিল্পকে বাঁচাতে কার্যকর নীতিমালা ও সরকারি সহায়তা প্রদানের আহ্বান জানান। সিনেমা আমদানি ও প্রদর্শনের সুযোগ বৃদ্ধি করলে কোনও একদিন মধুবন সিনেপ্লেক্স আবারো আলো ঝলকানিতে দর্শকদের স্বাগত জানাতে পারে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন এই হল মালিক।