বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের সব ইউনিট বন্ধ হয়ে গেছে। এতে উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। এর কারণে উত্তরের জেলাগুলোতে লোডশেডিং দেখা দিয়েছে।
লোডশেডিং দেখা দেওয়ায় বিপাকে পড়েছে বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল কল-কারখানা ও দোকানপাট। সেই সঙ্গে কৃষির ওপরও প্রভাব। এই অবস্থা চলতে থাকলে মারাত্মক ক্ষতির আশঙ্কা দেখছেন চেম্বার অব কমার্সের নেতারা।
তাদের মতে, বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং একটি ইউনিট ৫ বছর ধরে বন্ধ থাকার বিষয়টি দুঃখজনক।
বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, দ্রুতই ইউনিট চালু করা না হলে এই সংকট আরও বাড়বে। যদিও এই কেন্দ্র পুরোপুরি চালু হওয়া নিয়ে সঠিক সময়ক্ষণ বা মন্তব্য দিতে পারেনি তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ।
কেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তিনটি ইউনিটের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৫২৫ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ১ ও ২নং ইউনিট ১২৫ মেগাওয়াট করে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম। আর ৩নং ইউনিটটি ২৭৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন।
২০২০ সালের নভেম্বর মাস থেকে বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ২নং ইউনিটটি বন্ধ রয়েছে। গত ১৬ অক্টোবর (বৃহস্পতিবার) সকালে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে কেন্দ্রের ৩নং ইউনিটটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর থেকে শুধুমাত্র ১নং ইউনিট থেকে ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হচ্ছিল। গত রবিবার (১৯ অক্টোবর) দিবাগত রাতে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ১২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন ১নং ইউনিটের বয়লারে টিউব লিক করে। ফলে ওই ইউনিটটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। সব ইউনিট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বর্তমানে এই কেন্দ্র থেকে কোনও বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রের প্রধান প্রকৌশলী আবু বকর সিদ্দিক।
বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎ থেকে যে পরিমাণে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় তা জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়। তবে উত্তরাঞ্চলের ভোল্টেজ ঠিক রাখার জন্য এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে বিদ্যুতের ঘাটতি, আর অন্যদিকে বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ। ফলে লোডশেডিংয়ের মধ্যে পড়েছে উত্তরের ৮টি জেলা। ইতিমধ্যেই প্রতিটি এলাকাতেই লোডশেডিং শুরু হয়েছে।
ফুলবাড়ী উপজেলার তেঁতুলিয়া এলাকার চাল ও চিড়া তৈরির মিল মালিক মিজানুর রহমান জানান, বিদ্যুৎ না থাকলে কাজ বন্ধ। ঘরে প্রচণ্ড গরমে কাজ করতে পারেন না শ্রমিকরা। অথচ তাদেরকে হাজিরা ঠিকই দিতে হয়। প্রায় ১৬ জন শ্রমিক কাজ করে। এখন এমন অবস্থা যে লোডশেডিং বাড়ছে, ফলে কারখানার যে মেশিন, সেগুলোও নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা।
চিরিরবন্দর বটতলী এলাকার ওয়েলডিং কারখানায় আখতারুল ইসলাম বলেন, লোডশেডিং বাড়লে আমাদের কাজ বন্ধ থাকে। ফলে আমাদের যে উপার্জন তাতে ভাটা পড়ে।
সদর উপজেলার শেখপুরা ইউনিয়নের বোলতৈড় এলাকার কৃষক সেলিম রেজা বলেন, ইতিমধ্যেই গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিং দেখা দিয়েছে এবং তা বাড়ছে। সামনে বোরো মৌসুম, যদি লোডশেডিং এভাবেই থাকে তাহলে আমাদের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাবে। অন্তত কৃষকদের কথা মাথায় রেখে এই এলাকার লোডশেডিং যেন কমানো হয়।
একই উপজেলার দক্ষিণনগর এলাকার বেনু রাম সরকার বলেন, বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে শুনেছি। এর কারণেই হয়তো লোডশেডিং। প্রতি বছর বেশ কয়েকবার করে বন্ধ হয়ে যায় এই কেন্দ্র। আমাদের কৃষকদের পানি সেচের সময় যদি লোডশেডিং হয় তাহলে তো উৎপাদন খরচ বাড়ে আবার ফসলও ভালো হয় না।
দিনাজপুর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক সহিদুর রহমান পাটোয়ারী মোহন বলেন, লোডশেডিং শুরু হয়ে গেছে। কেন্দ্রের একটি ইউনিট ৫ বছর ধরে বন্ধ। আর দুটি ইউনিট বারবার বন্ধ হচ্ছে, এটি খুবই দুঃখজনক। বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করা হয়েছে এই অঞ্চলের ধানের আবাদ ও চালকলের আর্থ সামাজিক উন্নয়নের জন্য। সেখানে একটি ইউনিট দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ। ইতিমধ্যেই ধান ওঠা শুরু হয়েছে, ১৫-২০ দিন পর পুরোপুরিভাবে ধান ওঠা শুরু হবে। তখন চালকলগুলো উৎপাদনে যাবে। যদি এভাবে লোডশেডিং থাকে তাহলে তো চাল উৎপাদন হবে না। আবার ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হবে বোরো ধানের রোপণ কার্যক্রম। কৃষকের পানির চাহিদার সময় বিদ্যুতের সরবরাহ না থাকলে ফসলের ক্ষতি হবে। দ্রুততার সঙ্গে দুটি ইউনিট চালু করা এবং দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা ইউনিটের বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। যাতে শিল্পের কোনও ক্ষতি না হয়, পাশাপাশি কৃষকদের বোরো ধানের উপরও কোনও প্রভাব না পড়ে।
কথা হলে বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রধান প্রকৌশলী আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ইউনিটগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় লোডশেডিং হচ্ছে এবং হবে। এই এলাকায় জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ হয়। এই অঞ্চলে ভোল্টেজ কন্ট্রোল করার জন্য এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ এলে লোডশেডিং হবে না। আমার তো ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কমে গেছে। এটা জাতীয় গ্রিড থেকে কাভার করতে হবে। জাতীয় গ্রিড সরবরাহ না হলে সমস্যা হবে, লোডশেডিং হবে। ১নং ইউনিটটি চালু করতে এক সপ্তাহ সময় লাগতে পারে। ৩নং ইউনিটটি বৃহস্পতিবার বন্ধ হয়েছিল, সেই সমস্যা ঠিক করে চালু করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু আরও বেশ কয়েকটি সমস্যা দেখা দিয়েছে। জোর করে চালু করলে মেশিন ভেঙে যেতে পারে। আমরা নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ ও আলোচনা করছি। তারা বিষয়টি দেখছে। কবে নাগাদ চালু হবে তা সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারেননি তিনি।
নর্দার্ন ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানির (নেসকো) রংপুর অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল ইসলাম মন্ডল বলেন, লোডশেডিং হচ্ছে। রংপুর অঞ্চলে চাহিদা ১০০০-১০৫০ মেগাওয়াট। আর পাওয়া যাচ্ছে ৮৫০-৯০০ মেগাওয়াট। সারা দেশ মেইনটেনেন্স করে জাতীয় গ্রিড। গ্রিড যদি মেইনটেনেন্স করতে পারে, অন্য জায়গা থেকে যদি বিদ্যুৎ আনতে পারে তাহলে হয়তো কম লোডশেডিং হবে। ইফেক্ট পড়েছে, ২৫০ মেগাওয়াট উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে, এটি বড় একটি ঘাটতি।

















