শ্রীলংকার রহস্যময় পাহাড় আদম পাহাড়। আদম চূড়া (শ্রীপদ বা পবিত্র পদচিহ্ন ) শ্রীলংকার দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের শ্রীপাড়া প্রদেশে অবস্থিত একটি পর্বত চূড়া যা বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীদের অতি পবিত্র স্থান।নানা কারণে এই পাহাড়টি রহস্যে ঘেরা।এই পাহারটিতে রয়েছে বিরাট আকারের এক পায়ের ছাপ।আর সে পায়ের ছাপ নিয়েই যত রহস্য।সব ধর্মের মানুষই এই পায়ের ছাপটিকে পবিত্র হিসেবে মনে করেন।
যুগেরর পর যুগ ধরেই বিশ্বে নানা রকম পায়ের ছাপ পাওয়া গেছে। এসব পায়ের ছাপ একেকটা একেক রকম। কিন্তু এসব পায়ের ছাপ সম্পর্কে মানুষের জানার আগ্রহ দীর্ঘদিন ধরে। এমনই এক পায়ের ছাপ আদম পাহাড়ে। শ্রীলংকার মুসলমানরা বিশ্বাস করেন পৃথিবীর আদি মানব হজরত আদম (আঃ) প্রথম এই শ্রীলংকায় পদার্পণ করেছিলেন।আর ওই পাহাড়ে যে পায়ে ছাপ রয়েছে ওটা তারই পায়ের ছাপ। তার জন্য সে পাহাড় ও পাহাড়ের ওই পায়ের ছাপ মুসলমানদের কাছে পবিত্র হিসেবে পরিণতি হয়ে আসছে।
বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন এই পদচিহ্নটি গৌতম বুদ্ধের ,হিন্দুরা বিশ্বাস করেন এই পদচিহ্নটি তাদের দেবতার শিবের এবং মুসলমান ও খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করেন এই পৃথিবীর প্রথম মানব আদমের পদচিহ্ন।সকলেরিই ধারনা সেই চূড়াতেই বা পাহাড়েই আমাদের আদি পিতা হজরত আদম (আঃ) বেহেশত থেকে সরাসরি আগমণ বা পতিত হয়েছিলেন। চূড়াটিতে আদম (আঃ) এর পায়ের যে চিহ্ন রয়েছে তার পরিমাপ হচ্ছে প্রায় ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি, দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থ হচ্ছে ২ ফুট ৬ ইঞ্চি। বৌদ্ধ ধর্ম মতে খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দে এই পদচিহ্ন আবিষ্কৃত হয়। আবিষ্কৃত হওয়ার পরে পদচিহ্নের চতুর্দিকে ঘেরাও দিয়ে রাখা হয়েছে।
পাহাড়টি অনেক উঁচু হওয়ার কারণে পৌঁছানো খুবই কষ্টসাধ্য।সেখানে পৌঁছাতে হলে প্রথমে নৌকায় কিছু পথ যেতে হয় ,তারপর পায়ে হেটে উঁচু পাহাড়ে উঠতে হয়। পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছানোর জন্য পাহাড়ের গা দিয়ে তিনটি রাস্তা তৈরি করা হয়েছে ।এছাড়াও পাহাড়টির অনেকাংশ সবুজ গাছে ঢাকা থাকার কারণে এই পাহাড়ে রয়েছে অনেক বিষাক্ত সাপ ,পোকামাকড়।তবে চূড়ার কাছাকাছি একটি ধাতব সিঁড়ি আছে। তাতে রয়েছে ৪০০০ ধাপ। এর প্রতিটি ধাপ নিরাপদ নয়।তার ওপর দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে শীর্ষে যেতে হলে কমপক্ষে ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা সময় লাগে। যুগ যুগ ধরে শত শত পর্যটক পরিভ্রমণ করেছে চূড়াটিতে।
জটিল এক আবহাওয়ার এক অঞ্চলের মধ্যে এর অবস্থান। বছরে মাত্র তিন থেকে চার মাস এ পাহাড়ে আরোহণ করা যায়। বছরের অন্য সময়টাতে এতে আরোহণ অসম্ভব হয়ে ওঠে।কারণ, কাব্যিক অর্থে বলা যায় এ পাহাড় তখন মেঘের ভিতর লুকিয়ে যায়। চারদিক থেকে মেঘে জেঁকে ধরে। চূড়াটির চারদিকে সবুজের বিপুল সমারোহ মাঝেমধ্যে পাহাড়ি উঁচু নিচু টিলা। পাহাড়ি চূড়ার আশপাশে রয়েছে অসংখ্য ছো্ট নদী এবং পাহাড়ি ঝরনা। পাহাড়ের চারপাশের বনাঞ্চল বিভিন্ন বন্যপ্রাণী সংরক্ষণাগার যেখানে হাতি থেকে চিতাবাঘ পর্যন্ত বিভিন্ন প্রজাতির এবং অনেক স্থানীয় প্রজাতি বাস করে।সব মিলে এক মায়াবী নয়নাভিরাম দৃশ্য।
বৌদ্ধরা মনে করেন ওই পদচিহ্ন হলো বুদ্ধের বাম পায়ের। বুদ্ধ তার অন্য পা রেখেছিলেন বর্তমানের থাইল্যান্ডে আগে যা সিয়াম নামে পরিচিত ছিল। থাইল্যান্ডে রয়েছে তার ডান পায়ের ছাপ। থাই ভাসায় তাকে বলা হয় ফ্রা স্যাত। সেখানে পায়ের ছাপের যে মাপ তা আদম পাহাড়ের পায়ের ছাপের মতোই। আকারও এক রকম। একই রকম পদচিহ্ন আরও পাওয়া গেছে লাওসে, ক্যাবোজে ও চীনে। বৌদ্ধরা ধারণা করেন বুদ্ধ ছিলেন ৩৫ ফুট লম্বা। তাই তিনি এত দূরে দূরে পা ফেলতেন।তবে এই পদচিহ্নকে খ্রিস্টানরাও সম্মানের চোখে দেখে।
হিন্দুরা এই পায়ের চিহ্নকে তাদের দেবতার শিবের বলে বিশ্বাস করেন রামায়ণ মতে রাবণ যখন শ্রীলঙ্কা শাসন করত পথ পদচিহ্নটি তখনকার।মুসলমান ও খ্রিস্টানদের বিশ্বাস পৃথিবীর প্রথম মানুষ মানবজাতির আদি পিতা হযরত আদম নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণ করার কারণে আল্লাহ কর্তৃক স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হন এবং এখানে প্রথম পৃথিবীতে নামেন। আদম- ৯০ ফুট লম্বা ছিলেন।আদম পৃথিবীতে এসে চরম অনুতপ্ত হয়ে পড়েন এবং তার ভুলের জন্য আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করেন।তখন তিনি ভুলের প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ এক পায়ে হাজার বছর দাঁড়িয়ে থাকেন এবং কান্নাকাটি করতে থাকেন ।তার ফলস্বরূপ এখানে তার পবিত্র পা এর পদচিহ্ন এর দাগ পড়ে যায়।
১৫০৫ সালে শ্রীলংকা সফরে এসেছিলেন পর্তুগিজ এক নাগরিক। তিনি সে পাহাড়কে বলেছেন পিকো ডি আদম। তারা মনে করেন সেইন্ট থমাস দ্য ডাউবটার ভারত এবং শ্রীলংকা এসেছিলেন। তারপর তিনি এই পাহাড়ে পা রেখে স্বর্গে চলে গিয়েছেন।
সে পাহাড়ের চূড়া সামান্য একটি সমতল ক্ষেত্র।১৮১৬ সালে লেফটেন্যান্ট ম্যালকম এর পরিমাপ করেন। তাতে দেখা যায় এর দৈর্ঘ্য ৭৪ ফুট এবং প্রস্থ মাত্র ২৪ ফুট। মোট আয়তন ১৭৭৬ বর্গফুট। এর চূড়ায় রয়েছে একটি প্রকাণ্ড পাথরখণ্ড। এর উচ্চতা ৮ ফুট। এর ওপরেই রয়েছে ওই পদচিহ্ন।এর দৈর্ঘ্য ৬৮ ইঞ্চি। ৩১ ইঞ্চি চওড়া।
বিশ্বের যেসব নামকরা পর্যটক এই পাহাড়টি ভ্রমণ করেছেন।
তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ইবনে বতুতা ও মার্কো পোলো ।ভ্রমণ পিপাসু মার্কো পোলো আদমের পদচিহ্নে তার সম্মান জানানোর জন্য আরোহণ করেন সে পাহাড়ে। তিনি ১২৯২ সালে চীন থেকে ভেনিস যাওয়ার পথে সে সফর করেন।কেউ কেউ মনে করতেন সেটিই বিশ্বের সর্বোচ্চ পাহাড়। ৮৫১ সালে সে পাহাড়ে পদচিহ্ন প্রথম দেখতে পান আরবের সোলাইমান। রত্নপুরা হয়ে পবিত্র সে পাহাড়ে আরোহণ করেছিলেন বিখ্যাত আরব দার্শনিক ইবনে বতুতা।
ব্রিটিশ ব্যক্তিত্ব পারসিভাল যিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে কলম্বোর সেনা দুর্গে কাজ করেছিলেন, তিনি শ্রী পদের ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে বললেন,আদমের চূড়ার পর্বতে উঠার যে লোহার সিঁড়ি প্রথিত বা দেখা যায় তা বহু পূর্ব থেকে আসে ,কিন্তু কে বা কারা তা সেখানে স্থাপন করেছেন তা জানা যায়নি। যে বিশ্বাস এবং কুসংস্কার স্থান ওদের মধ্যে রয়েছে তাও খুব জটিল বা দুর্বল যাই হোক সকল স্বাক্ষর প্রমাণ এটাই নির্দেশ করে যে এই চূড়া বিখ্যাত ছিল এই দ্বীপের ইতিহাস লেখার অনেক অনেক আগে থেকেই।
সে পাহাড় এবং পাহাড়ের পদচিহ্ন নিয়ে একটি বই লিখেছেন মারকুস অকসল্যান্ড। বইটির নাম দ্য স্যাক্রেট ফুটপ্রিন্ট এ কালচারাল হিস্ট্রি অব আদমস পিক। তাতে বলা হয়েছে সে পাহাড়টি ২২৪৩ মিটার উঁচু। আকৃতি কোণের মতো। ভারত মহাসাগর থেকে সে পাহাড় পরিষ্কারভাবে দেখা যায়। আগেকার দিকে আরবের সৌখিন ব্যক্তিরা সমুদ্র যাত্রায় পাহাড় বলেও অভিহিত করেছেন।
এমন আরো অনেক রহস্য আছে এই পাহাড়টিকে কেন্দ্র করে ।এই রহস্যময় পাহাড়ের রহস্য উদঘাটনের জন্য দিন দিন মানুষের জানার আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। লাখ লাখ বছর ধরে চলে আসা যে রহস্য আজও মানুষ জানতে পারেনি আর সেটা হলো চূড়ার যে স্থানে আদম আঃ এর পায়ের চিহ্ন রয়েছে। অতি চমৎকার এই চূড়াটি বছরের পর বছর অবিকল রয়ে গেছে।এর সৌন্দর্য এতটুকু হ্রাস পায়নি ।সে কারণে চূড়াটি বিশ্বের মানুষের কাছে পবিত্র বলে পরিচিত।সকল ধর্মের মানুষের কাছে পবিত্র স্থান বলে পরিচিত। বিশ্বের সকল ধর্মের মানুষেরাই চূড়ার এই পদচিহ্নকে পবিত্র বলে মনে করেন।