জুলাই গণঅভ্যুত্থানে গাজীপুরের কোনাবাড়ী এলাকায় গুলিতে নিহত শিক্ষার্থী মো. হৃদয়ের (২০) লাশের সন্ধানে প্রায় এক বছর পর অভিযান চালিয়েছে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত গাজীপুর নগরের কড্ডা এলাকায় তুরাগ নদে এ অভিযান চালানো হয়। এ সময় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কর্মকর্তা ও পুলিশ সদস্যরাসহ নিহতের স্বজনরা উপস্থিত ছিলেন। তবে লাশের সন্ধান পাওয়া যায়নি।
আন্তর্জাতিক অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের তদন্ত দলের নেতৃত্বে পরিচালিত এ অভিযানে অংশ নিয়েছে গাজীপুর, টঙ্গী ও ঢাকার ডুবুরি দল। অভিযানে পাওয়া তথ্য অনুসারে, গ্রেফতারকৃত এক আসামির স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে হৃদয়ের লাশ উদ্ধারে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়।
নিহত হৃদয় টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার আলম নগর গ্রামের লাল মিয়ার ছেলে। তিনি হেমনগর ডিগ্রি কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন। পড়ালেখার পাশাপাশি কোনাবাড়ীতে অটোরিকশা চালাতেন। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিখোঁজ হন। এখন পর্যন্ত তার লাশ খুঁজে পায়নি পরিবার। হৃদয়ের ফুফাতো ভাই মো. ইব্রাহীম গত বছরের ২৬ আগস্ট কোনাবাড়ী থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলায় ৫৭ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা পুলিশ সদস্যসহ অনেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়।
মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘ইন্টারন্যাশনাল ট্রুথ জাস্টিস প্রজেক্ট’ ও ‘টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউট’ হৃদয়ের ঘটনাটি নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করে। সেখানে হৃদয়কে গুলি করার দৃশ্যও উঠে আসে। এরপর থেকেই বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসে। তদন্তের ভিত্তিতে পুলিশ সদস্য আকরাম হোসেনসহ আরও একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী আজ সকালে তুরাগ নদে ডুবুরি দল লাশের সন্ধানে নামে। বিকাল পর্যন্ত চলছিল উদ্ধার অভিযান।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর এস এম তাসমিরুল ইসলাম, গাজীপুর ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক মোহাম্মদ মামুন এবং মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের পরিদর্শক মাসুদ পারভেজ।
গাজীপুর মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক সাইফুল ইসলাম বলেন, এ ঘটনায় কিশোরগঞ্জের পারাইল এলাকা থেকে পুলিশ কনস্টেবল আকরাম হোসেনসহ (২২) এ পর্যন্ত ১১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কনস্টেবল আকরাম হোসেন গাজীপুর শিল্প পুলিশে কর্মরত ছিলেন। এদের মধ্যে যে গাড়িতে করে নিহতের লাশ তুরাগ নদীতে ফেলা হয়েছিল ওই গাড়ির চালককে সম্প্রতি গ্রেফতার করা হয়। তার দেওয়া তথ্য ও দেখানো মতে তুরাগ নদের কড্ডা এলাকায় অভিযান চালানো হয়। তবে লাশের সন্ধান পাওয়া যায়নি।
গাজীপুর ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক মোহাম্মদ মামুন বলেন, হৃদয়ের লাশ খুঁজতে গাজীপুর ফায়ার সার্ভিসের চার সদস্যের ডুবুরি দলের দল সকাল ১০টার দিকে তুরাগ নদীর কড্ডা এলাকায় অভিযান শুরু করে। বিকাল ৩টা পর্যন্ত নদীর ভাটির দিকে প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকাব্যাপী অভিযান চালিয়েও লাশের সন্ধান পাওয়া যায়নি।
অভিযানের সময় উপস্থিত নিহতের বড় বোন জেসমিন আক্তার বলেন, আমার ভাইকে পুলিশ গুলি করে মেরেছে। এর ভিডিও সব জায়গায় আছে। অথচ আজও আমার ভাই শহীদের মর্যাদা পায়নি। আমার ভাইয়ের লাশের সন্ধান পেতে আরও দু-এক বছর লাগলেও আমি আশাবাদী। কারণ, আমার ভাইয়ের হাঁড়ও যদি পাই, তা গ্রামের বাড়িতে নিয়ে মাটি দিতে পারলে বাবা-মা শান্তি পাবে। তারা সবসময়ই কান্নাকাটি করেন। ভাইয়ের লাশ আমাদের পারিবারিক গোরস্থানে নিয়ে মাটি দিতে পারলে তাদের কষ্ট কিছুটা হলেও দূর হবে।
এ ঘটনায় করা মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, নিহত হৃদয় ও তার মামাতো ভাই ইব্রাহীম গাজীপুরের কোনাবাড়ী এলাকায় অটোরিকশা চালাতেন। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট তাঁরা কুদ্দুছ নগর অ্যাঞ্জেল গেট সংলগ্ন সড়কে অবস্থান করছিলেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অংশ হিসেবে সেদিন ছাত্র-জনতা সরকারবিরোধী বিভিন্ন দাবিতে স্লোগান দিচ্ছিল। তখন সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লা এবং সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলমের নির্দেশে ২৫০ থেকে ৩০০ অজ্ঞাত সন্ত্রাসী ছাত্রদের ওপর হামলা চালায়। ওই সময় প্রাণভয়ে হৃদয় একটি দোকানে আশ্রয় নেন। পরে অজ্ঞাতনামা পুলিশ সদস্যরা তাকে দোকান থেকে টেনে রাস্তায় নিয়ে আসেন। এরপর এক পুলিশ সদস্য অস্ত্র পেটে ঠেকিয়ে গুলি করেন। ঘটনার সময় আশপাশের লোকজন এবং হৃদয়ের স্বজনেরা ভিডিও ধারণ করেন।