স্বাধীনতা পুরস্কার, বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত বরেণ্য শিক্ষাবিদ, বাম রাজনৈতিক ও মননশীল লেখক অধ্যাপক যতীন সরকারকে শেষবারের মতো ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদনের মাধ্যমে শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়েছে।
৮৯ বছর বয়সী জ্ঞানতাপস যতীন সরকারের প্রয়াণে শোকে কাতর পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, ভক্ত, অনুরাগীসহ পুরো নেত্রকোনাবাসী।
বুধবার (১৩ আগস্ট) বিকাল পৌনে ৩টার দিকে তিনি ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এরপর রাতে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়। মৃত্যুকালে যতীন সরকার স্ত্রী কানন আইচ, ছেলে সুমন সরকার, মেয়ে সুদীপ্তা সরকার ও নাতি নাতনিসহ রেখে গেছেন।
পরিবার জানায়, দীর্ঘদিন ধরে তিনি বার্ধক্যজনিত নানারকম অসুস্থতায় ভুগছিলেন। এরইমধ্যে গত ৩-৪ মাস আগে তিনি বাসায় পড়ে পায়ের উরুতে আঘাত পান। তারপর ঢাকায় চিকিৎসা শেষ সম্প্রতি বাসায় ফিরেছিলেন। কিন্তু অবস্থার অবনতি হলে তাকে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
তার মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পর ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে ভক্ত-অনুরাগীরা জড়ো হন। তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় উদীচী কার্যালয়ে। সেখানে ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে রাত সাড়ে আটটার দিকে নেত্রকোনা জেলা শহরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাখা হয়। এখানে শেষবারের মতো ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন করেন জেলার সর্বস্তরের নাগরিকসহ জেলার প্রশাসন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গ।
শ্রদ্ধা জানাতে আসেন নেত্রকোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. খন্দকার মোহাম্মদ আশরাফুল মুনিম, পুলিশ সুপার মির্জা সায়েম মাহমুদ, জেলা প্রশাসনের স্থানীয় সরকারের উপপরিচালক ও পৌর প্রশাসক আরিফুল ইসলাম সরদার, লেখক গবেষক আলী আহমেদ খান আইয়োব, চন্দ্রনাথ কলেজের অধ্যক্ষ আনোয়ার হাসান, নেত্রকোনা সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা, নেত্রকোনা সরকারি মহিলা কলেজের সহকারী অধ্যাপক মো. কামরুল হাসান, প্রত্যাশা সাহিত্য গোষ্ঠীর সভাপতি মনির হোসেন বরুণ, সাহিত্য সমাজের সভাপতি কিবরিয়া চৌধুরী হেলিম, প্রগতিশীল লেখক ফোরামের স্বপন পালসহ জেলা শহরের শতাধিক সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
পরে শহরের উদীচী কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয় মরদেহ। সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে নেত্রকোনা কমিউনিস্ট পার্টির কালিবাড়ি কার্যালয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সাতপাই নিজ বাসা বানপ্রস্থতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেও চলে শ্রদ্ধা নিবেদন। শ্রদ্ধা জানাতে আসেন যতীন সরকারের জন্মভূমি জেলার কেন্দুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইমদাদুল হক তালুকদার, কেন্দুয়া মিডিয়া ক্লাবের সভাপতি সাংবাদিক সমরেন্দ্র বিশ্বশর্মা, কেন্দুয়া প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল হাই সেলিম, কেন্দুয়া রিপোর্টার্স ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও চর্চা সাহিত্য আড্ডার সমন্বয়কারী রহমান জীবন, উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী কেন্দুয়া শাখার সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন সরকারসহ অনেকেই।
পরে মরদেহটি রাত ১টার দিকে জেলা সদরের চকপাড়া মহাশ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়। মধ্যরাত থেকে শেষ রাত পর্যন্ত শেষকৃত্যের মাধ্যমে নেত্রকোনাবাসী চির বিদায় দেন অধ্যাপক যতীন সরকারকে।
সংস্কৃতির ধারাবাহিক সংগ্রামের এক অনির্বাণ যোদ্ধা অধ্যাপক যতীন সরকার। সাম্যবাদী ও মানবতাবাদী লেখক, প্রাবন্ধিক যতীন সরকার পেয়েছেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মান স্বাধীনতা পুরস্কার, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, খালেকদাদ চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কার, রবীন্দ্র পদকসহ অসংখ্য পুরস্কার, পদক ও সম্মাননা।
নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার আশুজিয়া ইউনিয়নের চন্দপাড়া গ্রামে ১৯৩৬ সালের ১৮ আগস্ট এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম যতীন সরকারের। তার বাবা জ্ঞানেন্দ্র চন্দ্র সরকার ও মা বিমলা বালা সরকার। পরিবারটিতে অভাব-অনটন থাকলেও গ্রামীণ সম্ভ্রান্ত শিক্ষিত পরিবার হওয়ায় যতীন সরকার শৈশবেই শিখেছিলেন সংস্কৃত সাহিত্যের পাঠ।
আর্থিক দুরাবস্থার কারণে শিক্ষা জীবনকে টেনে নিতে টিউশন, শিক্ষকতা থেকে শুরু করে পান সিগারেটের দোকানদারিও করেছেন তিনি। এভাবেই ১৯৫৪ সালে মেট্রিকুলেশন এবং ১৯৬৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে এম এ পাস করেন। পরে ১৯৬৪ সাল থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত ময়মনসিংহ নাসিরাবাদ কলেজে বাংলা বিভাগে ৪২ বছর অধ্যাপনা করেন। অবসর জীবনে তিনি সহধর্মিণী কানন আইচকে নিয়ে নেত্রকোনা পৌর শহরের সাতপাই এলাকায় ‘বানপ্রস্থ’ বাসভবনে বসবাস করে আসছিলেন।
যতীন সরকার অর্ধশতাধিক গ্রন্থ রচনা করে গেছেন। তার প্রথম বই ‘সাহিত্যের কাছে প্রত্যাশা’। এরপর তিনি অবিরত লিখে গেছেন। তার অন্যান্য কয়েকটি বই হলো ‘পাকিস্তানের জন্ম-মৃত্যু দর্শন’, ‘পাকিস্তানের ভূতদর্শন’, ‘প্রাকৃতজনের জীবনদর্শন’, ‘বাঙালির সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্য’, ‘বিনষ্ট রাজনীতি ও সংস্কৃতি’, ‘আমার রবীন্দ্র অবলোকন’, ‘প্রত্যয় প্রতিজ্ঞা প্রতিভা’, ‘সংস্কৃতি ভাবনা’, ‘গল্পে গল্পে ব্যাকরণ’, ‘মানবমন মানবধর্ম ও সমাজবিপ্লব’, ‘ভাবনার মুক্তবাতায়ন’ ‘বাংলাদেশের কবি গান’।

















