
সরকার মাজহারুল মান্নান, রংপুর:
রংপুরে গেল বছর ১৯ জুলাই গুলিতে নিহত স্বর্ণ শ্রমিক মুসলিম উদ্দিন মিলনের দাফনের পর তার বাড়িতে অভিযান চালিয়েছিল যৌথ বাহিনী। ৫ আগস্ট পর্যন্ত পরিবারের সবাই ছিলেন পলাতক। এ কথা জানিয়েছেন তার স্ত্রী দিলরুবা আক্তার। শুধু তাই নয় হাসপাতালে লাশও গুম করার চেস্টা করা হয়েছিল বলেও জানান তিনি।
শনিবার (১৯ জুলাই) তার শাহাদতের দিনে যমুনা টেলিভিশনকে একথা বলেন দিলরুবা বেগম। দিলরুবা নগরীর বৌরানী জুয়েলার্সের ম্যানেজার গুড়াতিপাড়ার বাসিন্দা শহীদ মুসলিম উদ্দিন মিলনের স্ত্রী।
ঘটনার বিষয়ে দিলরুবা বলেন, আমার স্বামী নামাজ শেষে আড়াইটার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। মারা যায় বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে। আসরের নামাজও মসজিদে পড়েছিল। আমার স্বামী আন্দোলনের সামনে ছিল। একটা গুলি লাগে বুক বরাবর। ওখানেই মারা যায়। এরপর ছেলে কোনো রকমে মেডিকেলে নিয়ে যায়।
মেডিকেল থেকে লাশ নেয়ার দুঃসহ যন্ত্রণার কথা উল্লেখ করে দিলরুবা বলেন, লাশটা মেডিকেলে নেয়ার পর হাসপাতালের কর্মকর্তারা আমাদের খুব হেনস্তা করেছে। এখান থেকে ওখানে। দুইতলা , তিনতলা, চারতলা। একেকবার একেক জায়গায় নিয়ে যায়। তারা চেষ্টা করছিল কোনোভাবে লাশ গুম করা যায় কিনা। যেহেতু আমরা পিছে পিছে ছিলাম। তারা যদি লাশটা রুমে নিতে পারতো। তাহলে লাশটা কিন্তু আমাদের দিতো না। ওরা লাশটাকে গায়েব করে দিতো। আমার পরিবারের লোকজন, আমার ভাতিজা আমার ভাসুর, আমার ননদ, আত্মীয় স্বজনরা মিলে প্রায় ৫০ জন লোক আমরা লাশের সাথে ছিলাম। পাহারা দিয়েছি। অনেক চিৎকার করেছি। তারা লাশ দিতে চায় না। আমরা থ্রেট দিয়েছি। লাশ সরালে কারো ভালো হবে না। আমরা তুলকালাম করবো। সবাইকে শেষ করে দিবো। এরকম ভয় দেখানোর পর কোন রকমে আমাদের লাশটা দেয়। তাও লাশটা দিয়েছে রাত ৯টায়।
লাশ দাফনের চারদিনের মাথায় গভীর রাতে বাড়িতে যৌথবাহিনীর অভিযানের বিভিষিকাময় পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে দিলরুবা বলেন, আমার স্বামী মারা যাওয়ার রাতে আনুমানিক ২টার দিকে বিজিবি পুলিশসহ প্রায় ৫০ জন যৌথবাহিনীর লোক পুরো বাড়ি ঘিরে ফেলে। আমার ভাসুর দোতালার ছাদ দিয়ে পালিয়ে যায়। কেউ জানালা দিয়ে পালিয়ে যায়। তাদেরকে ধরার জন্যই এসেছিল। তারা অনেক গালাগালি করে। হুমকি দেয়। এসময় তারা একটা নতুন ফোন নিয়ে যায়। তখন থেকে বাড়ির সব পুরুষরা পালিয়ে ছিল। পরে ৫ তারিখে হাসিনার পতনের পর তারা পলাতক জীবন ছেড়ে বাড়িতে আসে। একে তো মৃত্যু, শোকে শোকাহত আমরা সবাই। তারপর চারদিনের মাথায় তারা আসে আমাদের গ্রেফতার করার জন্য। কী নির্মম ইতিহাস এটা। আমরা তাদের কাছে গিয়ে এতোবার ফোনটা চেয়েছি। সেটাও দেয়নি তারা।
তিনি বলেন, আমরা তো সব হারিয়ে এখন সর্বশান্ত। আমাদের কিছুই নেই পৃথিবীতে। সর্বশান্ত আমার পৃথিবী। আমার দুটো ছোট ছোট ছেলে বাচ্চা আছে। বাচ্চাদের মুখ থেকে বাবা ডাকটা কেড়ে নিলো। সারা জীবনের জন্য। তারা এতিম হয়ে গেলো। তাদের দায়িত্ব কে নিবে? সরকারকেই তো নিতে হবে। কিন্তু সরকার একবছরেও সেটা নেয়নি। নেয়ার কোনো আলামতও নাই।
দিলরুবা আরও বলেন, মামলা করেছি। কিন্তু বিচার কোনো শহীদ পরিবারই পাচ্ছি না। আসামি গ্রেফতার হচ্ছে না। আমরা চাই প্রতিটা আসামি গ্রেফতার হোক। একটা বছর অতিবাহিত হয়ে গেলেও মামলার কোনো সুরাহা নাই। যেখানে একদিন নেয়াও উচিত না। সেখানে একবছর চলে গেল। মাত্র ২ জন গ্রেফতার হয়েছে আমার মামলায়। এটা মানা যায় না।
শহীদ ও আহত পরিবারকে পুনর্বাসনের দাবি জানিয়ে দিলরুবা বলেন, আমাদের কথা, আমাদের দাবি, আমাদের প্রত্যেকটা শহীদ পরিবারকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। মাসিক ভাতাটা এখনও চালু করা হয়নি। সেটা একমাস সময় নেয়া উচিত নয়। তাদের পরিবারগুলো কীভাবে চলবে। কী খাবে, কীভাবে বাঁচবে। সেখানে একবছর হয়ে গেল ভাতা চালু হলো না। আমরা হতাশ। এটা দ্রুত বাস্তবায়ন করা দরকার।
স্বামী মুসলিম উদ্দিন মিলন খুনের ঘটনায় গত বছর ২৭ আগস্ট স্ত্রী দিলরুবা আখতার জাতীয় সংসদের সাবেক স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, মামলায় রংপুর বিভাগীয় কমিশনার জাকির হোসেন, রংপুর রেঞ্জের সাবেক ডিআইজি আব্দুল বাতেন, রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের সাবেক কমিশনার মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, সাবেক জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোবাশ্বের হাসান, রংপুর জেলার সাবেক পুলিশ সুপার মো. শাহজাহান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এ সার্কেল) হুসাইন মোহাম্মদ রায়হান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বি সার্কেল) আবু আশরাফ সিদ্দিকী, সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, সাবেক স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, সাবেক সংসদ সদস্য নাছিমা জামান ববি, জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি আব্দুল মালেক, সাধারণ সম্পাদক আব্দুল হক প্রামাণিক, আওয়ামী লীগ নেতা রাশেক রহমান, সাবেক সংসদ সদস্য আবুল কালাম মোহাম্মদ আহসানুল হক চৌধুরী ডিউক, জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ছায়াদাত হোসেন বকুল, মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি শফিয়ার রহমান সাফি ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক তুষার কান্তি মন্ডলসহ ১৭ জনের নাম উল্লেখে করে একটি মামলা করেন। পরবর্তীতে আদালতের আদেশে মহানগর কোতয়ালী থানা মামলাটি এজাহার হিসেবে গ্রহণ করে তদন্ত শুরু করে। এক বছরে ওই মামলায় গ্রেফতার হয়েছে মাত্র ২ জন। মামলাটি এখন তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ। ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ দাফন করায়, তদন্তের স্বার্থে গত বছর ১৫ সেপ্টেম্বর মুন্সিপাড়া কবরস্থান থেকে তার লাশ উত্তোলন করা হয়।
গেল বছর ১৬ জুলাই রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নং গেটের সামনে দুই হাত প্রসারিত করে বুক উঁচিয়ে পুলিশের গুলি বরণ করে শহীদ হন শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। আবু সাঈদ হত্যার দু’দিন পর ১৮ জুলাই রংপুরের মডার্ন মোড়ে আন্দোলনের সময় গুলিতে নিহত হন অটোচালক মানিক মিয়া। আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে পরিস্থিতি। ১৯ জুলাই সিটি বাজারের সামনে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভে বাধা দেয় পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। শুরু হয় নির্বিচারে গুলি। প্রাণ হারান কলা ব্যবসায়ী মেরাজুল ইসলাম বৌরানী জুয়েলার্সের ম্যানেজার মুসলিম উদ্দিন মিলন, সবজি ব্যবসায়ী সাজ্জাদ ও শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল তাহির।
/এটিএম

















