ভারতের নানা প্রান্তে গড়ে উঠছে ‘গারবেজ ক্যাফে’। প্লাস্টিক বর্জ্য কমানো এবং অভাবীদের খাবার জোগাতে এই অভিনব উদ্যোগের সূচনা হয়েছে ছত্তিশগড়ের আম্বিকাপুর শহরে।
২০২৫ সালের শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে আম্বিকাপুরের প্রথম গারবেজ ক্যাফের দরজায় ঢুকতেই ভেসে আসছে গরম সমুচার গন্ধ। ভেতরে কাঠের বেঞ্চে বসে কেউ গল্প করছেন, কেউ শান্তভাবে খাচ্ছেন ভাত, তরকারি, ডাল, রুটি, সালাদ আর আচারভর্তি থালা।

এখানে খাবার কিনতে টাকা লাগে না, লাগে প্লাস্টিক বর্জ্য। পুরোনো ব্যাগ, পানির বোতল বা খাবারের মোড়ক জমা দিলেই মিলছে খাবার। এক কেজি প্লাস্টিক দিলে পূর্ণাঙ্গ ভাত-তরকারির মিল, আর আধা কেজি প্লাস্টিক দিলে পাওয়া যায় সকালের নাস্তা—সমুচা বা বড়া পাও।
আম্বিকাপুর পৌর কর্পোরেশনের তত্ত্বাবধানে চালানো এই ক্যাফের দায়িত্বে আছেন বিনোদ কুমার পাটেল। তিনি বলেন,
‘একদিকে ক্ষুধা, অন্যদিকে প্লাস্টিক দূষণ—এই দুই সমস্যার সমাধান একসঙ্গেই করতে চেয়েছিলাম আমরা। সেজন্যই এই ক্যাফে খোলা হয়েছে।’
স্থানীয় নারী রাশমি মণ্ডল প্রতিদিন সকালে রাস্তায় বের হন প্লাস্টিক সংগ্রহে। আগে তিনি এই প্লাস্টিক বিক্রি করতেন মাত্র ১০ রুপিতে কেজি, যা দিয়ে সংসার চালানোই কষ্টকর ছিল। এখন সেই একই প্লাস্টিক দিয়ে পরিবারের জন্য খাবার আনতে পারেন। তিনি বলেন, ‘এই ক্যাফে আমাদের জীবনে বড় পরিবর্তন এনেছে’।
ক্যাফে চালুর পর প্রতিদিন গড়ে ২০ জন মানুষ এখানে খাবার পান। পাশাপাশি প্লাস্টিক বর্জ্য কমছে। শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় দায়িত্বে থাকা ঋতেশ সাইনি জানাচ্ছেন, ২০১৯ সাল থেকে এই ক্যাফে প্রায় ২৩ টন প্লাস্টিক সংগ্রহ করেছে। ২০১৯ সালে শহরে বছরে যেখানে ৫.৪ টন প্লাস্টিক ডাম্পিং গ্রাউন্ডে যেত, ২০২৪ সালে তা নেমে এসেছে ২ টনে।
আম্বিকাপুর প্রতিদিন ৪৫ টন কঠিন বর্জ্য উৎপাদন করে। আগে শহরের বাইরে ১৬ একর জায়গাজুড়ে ছিল বিশাল ডাম্পিং গ্রাউন্ড। ২০১৬ সালে সেটি পার্কে রূপান্তর করা হয় এবং চালু হয় শূন্য-ডাম্পিং সিস্টেম।
সংগ্রহ করা প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি হয় রাস্তাঘাটের উপকরণ বা বিক্রি হয় রিসাইক্লারদের কাছে। ভেজা বর্জ্য কম্পোস্টে পরিণত হয়, আর সামান্য অবশিষ্ট অনাবর্তনযোগ্য বর্জ্য সিমেন্ট কারখানায় জ্বালানি হিসেবে পাঠানো হয়। ফলে আম্বিকাপুর আজ পরিচিত হয়েছে ‘জিরো ল্যান্ডফিল সিটি’ হিসেবে।
এখন শহরে ২০টি স্থানীয় বর্জ্য সংগ্রহকেন্দ্র রয়েছে, যেখানে প্রতিদিন ৩০–৩৫ জন মানুষ প্লাস্টিক জমা দেন। এখানে কর্মরত ৪৮০ জন নারী, যাদের বলা হয় ‘স্বচ্ছতা দিদি’। মূলত, তারা ঘরে ঘরে গিয়ে বর্জ্য সংগ্রহ করেন এবং মাসে গড়ে ৮–১০ হাজার রুপি উপার্জন করেন।
এই ডোর-টু-ডোর সংগ্রহ পদ্ধতি এতটাই সফল হয়েছে যে ছত্তিশগড় রাজ্যের ৪৮টি ওয়ার্ডে চালু হয়েছে। সরকার বলছে, এর লক্ষ্য শুধু আম্বিকাপুর নয়, বরং মাঝারি আকারের আরও শহরের জন্য কার্যকরী, পরিবেশবান্ধব এবং আর্থিকভাবে টেকসই একটি মডেল তৈরি করা।
ভারতের আরও কিছু জায়গায় অনুরূপ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে—
- পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়িতে ২০১৯ সালে চালু হয় প্লাস্টিকের বিনিময়ে খাবার দেয়ার প্রকল্প।
- তেলেঙ্গানার মুলুগুতে এক কেজি প্লাস্টিক দিলে সমান ওজনের চাল দেয়া হয়।
- কর্ণাটকের মাইসুরুতে ২০২৪ সালে চালু হয় ব্যবস্থা, যেখানে ৫০০ গ্রাম প্লাস্টিক দিলে ফ্রি ব্রেকফাস্ট আর ১ কেজি প্লাস্টিক দিলে ফ্রি মিল মেলে।
- উত্তর প্রদেশে প্লাস্টিকের বিনিময়ে নারীদের স্যানিটারি ন্যাপকিন দেয়া হচ্ছে।
ভারতের বাইরে কম্বোডিয়ায়ও একই ধরনের উদ্যোগ দেখা গেছে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এই উদ্যোগগুলো মূল সমস্যার পুরো সমাধান নয়। প্লাস্টিকের অতিরিক্ত উৎপাদন, অনাবর্তনযোগ্য প্লাস্টিক এবং অধিকাংশ পরিবারের বর্জ্য আলাদা না করার কারণে সমস্যা থেকেই যাচ্ছে।
সূত্র: বিবিসি নিউজ।
/এআই