অনেকেই সিরিয়ার জনগণের স্বতন্ত্রতার কথা বলেন। তারা বলেন, সিরিয়ানরা কাজকে ভালোবাসে, নিজের চেষ্টায় ঘুরে দাঁড়াতে চায়, অলসভাবে বসে থাকে না। তারা শুধু রাষ্ট্র নির্ধারিত সীমিত আয়েই সন্তুষ্ট নয়। কেউ কেউ বলেন, আসাদের আমলের বাস্তুচ্যুতি ও নির্বাসন তাদের কর্মসংস্থানে স্বনির্ভর করে তুলেছে। তাই তারা বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে শুধু সরকারি সাহায্যের অপেক্ষায় বসে থাকবে না, বরং বেসরকারি পর্যায়েও দেশের পুনর্গঠনে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে।
তবে এখন পর্যন্ত সিরিয়ায় এমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। বরং বোঝা যাচ্ছে, প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল শারা নেতৃত্বাধীন সরকার পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে উদারনীতির পথে এগুচ্ছে। এজন্য তারা আরব ও উপসাগরীয় অংশীদারদের, এমনকি বিদেশি অংশীদারদেরও আমন্ত্রণ জানাবে।
ফলে আমরা এমন একটি অর্থনৈতিক চিত্র কল্পনা করতে পারি, যা আরব উদারনীতির অনুরূপ। এতে জাতীয়তাবাদী শাসন ব্যবস্থার অবসান ঘটবে— যে শাসন দরিদ্রদের সহায়তা, বিনামূল্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
এই নতুন মডেল আদৌ সফল হবে কিনা, তা এখন সিরিয়া এবং গোটা আরব বিশ্বে আলোচনার বিষয়। কারণ, এই অঞ্চলগুলো দীর্ঘদিন ধরে স্বনির্ভর রাষ্ট্রব্যবস্থার মোহে আবদ্ধ ছিল।
সিরিয়ার নতুন শাসনব্যবস্থা মানবিক ও অবকাঠামোগত ধ্বংসের উত্তরাধিকার বহন করছে, যার শিকড় ফরাসি ঔপনিবেশিক আমলে গ্রথিত। এ প্রেক্ষাপটে মিসর ও তিউনিসিয়ার অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেয়া যায়। সেখানে আরব বসন্তের পর সমাজকল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠন সম্ভব হয়নি, না উদারনীতির পূর্ণ রূপায়ণ ঘটেছে।
পুনর্গঠনের সবচেয়ে সহজ পথ মনে হতে পারে সরকারি ব্যয়ের মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়া। কিন্তু এতে আবার বাথ পার্টির সমাজতান্ত্রিক মডেলের পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে। অপরদিকে, জনগণকে পুরোপুরি ব্যক্তিখাতনির্ভর করে তোলাও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি, যা সশস্ত্র বিপ্লবের চেয়েও গভীরতর। কারণ, এটি স্বাধীনতার পর গড়ে ওঠা সহায়ক রাষ্ট্রের ধারণাকেই চ্যালেঞ্জ জানাবে। এখানেই নিহিত রয়েছে পুনর্গঠন ও উদ্ভাবনের সত্যিকারের ঝুঁকি।
উদারনীতি, ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও অর্থনৈতিক মুক্ত বাজার এই শব্দগুলো ১৯৭০-এর দশক থেকে আরব বিশ্বে পরিচিত। কিন্তু বাস্তবে এগুলোর বাস্তবায়ন এমনভাবে হয়েছে, যা কেবল পুঁজিবাদী স্বার্থই রক্ষা করেছে এবং দরিদ্রদের আরো দরিদ্র করে তুলেছে। এর ফলে একটি হাইব্রিড শ্রেণি তৈরি হয়েছে, আর সমাজকল্যাণমূলক লক্ষ্যগুলো হারিয়ে গেছে। অথচ প্রকৃত উদারনীতি মানে কেবল অর্থনৈতিক মুক্তি নয়; এর সাথে রাজনৈতিক স্বাধীনতাও থাকা উচিত। এই বিকৃত ব্যবস্থার বিরুদ্ধেই ছিল আরব বসন্ত, যেখানে জনগণ স্বাধীনতার দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমে এসেছিল।
এই বাস্তবতা এখন সিরিয়ার নতুন শাসকদের সামনে রয়েছে। তারা যদি সত্যিই উদারনীতির পথে হাঁটতে চায়, তবে স্বাধীনতার প্রশ্নকে উপেক্ষা করতে পারবে না। তবে তাদের উচিত হবে আরব বিশ্বের ব্যর্থ মডেল নয়, বরং নতুন কিছু ভাবা। এমন একটি সিরিয়ান মডেল, যাতে পশ্চিমা উদারনীতির সামাজিক দিকগুলো সম্পর্কেও সচেতনতা থাকবে।
সিরিয়ায় কর্তৃত্ববাদকে অনেক সময় যুক্তিযুক্ত বলে উপস্থাপন করা হয়। বলা হয়, দেশটির জাতিগত ও ধর্মীয় বৈচিত্র্য কেবল কঠোর শাসনের মাধ্যমেই টিকিয়ে রাখা সম্ভব। অথচ একই যুক্তি প্রয়োগ হয়েছে এমন দেশেও, যেখানে কোনো গোষ্ঠীগত বিভাজন নেই, যেমন তিউনিসিয়া। বলা হয়েছে, আরবরা স্বাধীনভাবে শাসন করতে পারে না; তারা ও গণতন্ত্র একসাথে চলে না।
এই মতবাদ খণ্ডন করতে সাহস লাগে। বিশেষ করে এমন এক সময়ে, যখন এর বিপরীত কিছু বাস্তবে দেখা যায়নি।
তবে যদি একটি কাঠামোর মধ্যে জনগণের রাজনৈতিক স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করা যায় এবং সেই সাথে ধাপে ধাপে অর্থনৈতিক স্বাধীনতাও বাস্তবায়িত হয়, তবে সম্ভাবনা তৈরি হয়। কিন্তু এই পথটি কঠিন। রাষ্ট্রের সম্পদের ঘাটতি ও রাজনৈতিক ঘুষ বা তুষ্টিকরণ সংস্কৃতির চাপে বাস্তবায়ন জটিল হয়ে ওঠে। বিপ্লব-পরবর্তী সরকার, যাদের বৈধতা আছে কিন্তু সম্পদ নেই এবং যাদের মানবসম্পদ এখনো পুরোপুরি প্রস্তুত নয়, তারা এক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়।
এমন পরিস্থিতিতে বিকল্প হতে পারে স্থানীয় সরকারব্যবস্থার বিকাশ, যা কেন্দ্রীভূত শাসনের পরিবর্তে বিকেন্দ্রীকৃত, অংশগ্রহণমূলক মডেল উপস্থাপন করে। পশ্চিমা অনেক রাষ্ট্র এই পথেই কার্যকর সরকারব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। তিউনিসিয়াও ২০১৪ সালের সংবিধানে এমন ব্যবস্থা আনার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় শাসন থেকে লাভবান গোষ্ঠীগুলোর বাধায় তা ভেস্তে যায় এবং একনায়কতন্ত্র আবার ফিরে আসে।
আমাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষা একটি প্রতিবাদ তাদের বিরুদ্ধে, যারা আমাদের নাম লিখতে শিখিয়েছিল। কিন্তু মনকে দারিদ্র্য, আত্মাকে পরাধীন এবং শরীরকে কেবল খাদ্যে তৃপ্ত রেখেছিল।
তাই আমরা সিরিয়ার দিকে তাকিয়ে আছি, আশা করছি তারা একটি নতুন মডেল তৈরি করবে, যা মানুষকে অবহেলা করবে না। বরং দেবে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা। এমন এক মডেল, যা শুধু পেট নয়, মনও তৃপ্ত করবে এবং ‘আরবরা কেবল লৌহমুষ্টি দিয়ে শাসনযোগ্য’ এই পুরনো ধারণার অবসান ঘটাবে।
এই নতুন বিকল্প মডেল তৈরির সম্ভাবনা অল্প নয়, যদিও পথটি সহজ নয়। সিরিয়ান জনগণের যেসব গুণাবলি আমরা শুনেছি তা আমাদের আশাবাদী করে তোলে।
আমরা সিরিয়ার দিকে তাকিয়ে আছি, এই প্রত্যাশায় যে সিরিয়া হবে এক উদার, স্বাধীন ও নাগরিকত্বনির্ভর রাষ্ট্র। একটি রাষ্ট্র, যা আরব জনগণের স্বপ্ন বাস্তবায়নের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেবে।
সশস্ত্র বিপ্লব না হোক, আমরা এমন এক স্থানীয় গণতন্ত্রের সাফল্যে খুশি হবো যা অস্ত্র ছাড়াই রফতানি ও আমদানি করা যায়।
সূত্র : আল জাজিরা মুবাশ্বের