দক্ষিণ এশিয়ায় যেন আছড়ে পড়েছে জেন-জি ঝড়। বাংলাদেশ-নেপালের পর সেই উত্তাপের আঁচ লেগেছে উত্তর ভারতেও। দেশটির চীন সীমান্তঘেঁষা অঞ্চল লাদাখে ফুঁসে ওঠা এ বিক্ষোভ এরইমধ্যে ভয়াবহ রক্তপাতের জন্ম দিয়েছে। আন্দোলনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে অন্তত চারজনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে দেশটির কেন্দ্রীয় ক্ষমতাসীন বিজেপির আঞ্চলিক কার্যালয়েও। মূলত, সাংবিধানিক সুরক্ষা ও রাজ্য মর্যাদার দাবিতে শুরু হয় এই আন্দোলন।
২০১৯ সালে মোদি সরকার জম্মু-কাশ্মিরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা ও রাজ্য পদমর্যাদা বাতিল করে। তখন ওই রাজ্যের তিনটি অঞ্চল ছিল— মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মির উপত্যকা, হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জম্মু এবং মুসলিম-বৌদ্ধ সমান জনসংখ্যার লাদাখ। পরে জম্মু-কাশ্মিরকে একটি আইনসভাসহ কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল এবং লাদাখকে আইনসভাহীন কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল বানানো হয়। এতে জম্মু-কাশ্মিরের জনগণ অন্তত স্থানীয় নেতাদের নির্বাচিত করার অধিকার পেলেও লাদাখ পুরোপুরি চলে যায় আমলাতান্ত্রিক শাসনের অধীনে। লাদাখের ৯০ শতাংশ মানুষ ‘তফসিলি জনজাতি’ হিসেবে তালিকাভুক্ত। তাই তারা ভারতের সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের আওতায় স্বায়ত্তশাসন ও সাংবিধানিক সুরক্ষা চাইছেন, যা উত্তর-পূর্ব ভারতের কিছু অঞ্চলে বিদ্যমান।
তবে, লাদাখকে এ পর্যন্ত রাজ্য মর্যাদা কিংবা ষষ্ঠ তফসিলের সুরক্ষা কোনোটাই দিতে রাজি হয়নি নরেন্দ্র মোদি সরকার। ফলে কর্মসংস্থানও কঠিন হয়ে পড়েছে সেখানকার তরুণদের জন্য। আগে জম্মু-কাশ্মির একত্রে থাকায় লাদাখের লোকজনও সেখানকার চাকরির আবেদন করতে পারতেন। যে সুবিধা বন্ধ হয়ে গেছে এখন।
হিমালয়ের উচ্চভূমির শীতল মরুভূমি অঞ্চল লাদাখে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বারবারই দেখা দিয়েছে ভারত-চীন উত্তেজনা। আর সেখানেই জেন-জি প্রজন্মের নেতৃত্বে ভয়াবহ বিক্ষোভ শুরু হয় বুধবার (২৪ সেপ্টেম্বর)। এক পর্যায়ে বিজেপির আঞ্চলিক কার্যালয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়ার মত ঘটনাও ঘটে।
এই পরিস্থিতিতে লাদাখের আঞ্চলিক রাজধানী লেহ শহরে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়াতে বাধ্য হয়েছে পুলিশ। চারজনের প্রাণহানির পাশাপাশি আহত হয়েছেন আরও বহু মানুষ। আহতদের মধ্যে একজন আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছেন। শুধুমাত্র আন্দোলনকারী কিংবা বেসামরিক নাগরিকরাই না, সংঘর্ষে আহত হয়েছেন নিরাপত্তা বাহিনীরও বহু সদস্যও।
রাজ্য মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও সাংবিধানিক সুরক্ষার দাবিতে বিগত ছয় বছর ধরে স্থানীয় সিভিল সংগঠনের নেতৃত্বে শান্তিপূর্ণ পদযাত্রা, অনশন কর্মসূচি চালিয়ে আসছিলেন লাদাখের মানুষ। তবে, বুধবার শান্তিপূর্ণ সেই আন্দোলন রেশ ভেঙে সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ে ক্ষুব্ধ তরুণরা।
ভারতের রাজনৈতিক বিশ্লেষক সিদ্দিক ওয়াহিদ বলেন, ২০১৯ সালে মোদি সরকারের পদক্ষেপ এখন বুমেরাং হয়ে ফিরে আসছে। আগে কাশ্মির ছিল অশান্তির কেন্দ্র, এখন লাদাখও তাতে যোগ হলো।
শিক্ষক ও সমাজকর্মী সোনাম ওয়াংচুক এক ভিডিও বার্তায় বলেন, এটা তরুণদের এক ধরনের বিস্ফোরণ— একটা জেন-জি বিপ্লব। শান্তিপূর্ণ আন্দোলন আর কাজে আসছে না বলে বিশ্বাস জন্মেছে তাদের মধ্যে। আমাদের তরুণরা পাঁচ বছর ধরে বেকার। তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। এটাই অশান্তির মূল কারণ। লাদাখে শুরু হওয়া এই আন্দোলনকে বাংলাদেশ-নেপালসহ সম্প্রতি দক্ষিণ এশিয়ায় ঘটে যাওয়া বিপ্লবগুলোর সঙ্গে তুলনা করছেন তিনি।
মোদি সরকারের অভিযোগ, ওয়াংচুক বিক্ষোভকারীদের উসকে দিয়েছেন। তিনি আরব বসন্তধর্মী আন্দোলন ও নেপাল-বাংলাদেশের জেন-জি বিক্ষোভের কথা উল্লেখ করে তরুণদের বিভ্রান্ত করছেন। তবে, ওয়াংচুক জোর দিয়ে বলছেন, তিনি কখনই সহিংসতার আহ্বান জানাননি; বরং সতর্ক করেছিলেন যে দাবিগুলো উপেক্ষা করলে তরুণদের ক্ষোভ ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
বুধবার সকালে লাদাখ এপেক্স বডির নেতৃত্বে ১৫তম দিনে প্রবেশ করে স্থানীয় আন্দোলনকারীদের অনশন। আগের রাতে দুই প্রবীণ অনশনকারীকে হাসপাতালে নিতে হয়। এরপরই সংগঠকেরা লকডাউনের ডাক দেন। একইসঙ্গে মোদি সরকারের পক্ষ থেকে আলোচনায় বিলম্ব হওয়ার কারণে ক্ষোভ বাড়তে থাকে।
এমন পরিস্থিতিতে আন্দোলনের কেন্দ্র মার্টিয়ার্স মেমোরিয়াল পার্ক থেকে বেরিয়ে স্থানীয় সরকারি ভবন ও বিজেপি কার্যালয়ের দিকে অগ্রসর হন তরুণরা এবং পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ান।
লাদাখ এপেক্স বডির সমন্বয়ক জিগমাত পালজোর বলেন, এটা লাদাখের ইতিহাসে সবচেয়ে রক্তাক্ত দিন। যারা রাস্তায় দাবি আদায়ে নেমেছিলেন, তাদের হত্যা করা হলো। তবে,দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য, অশান্ত তরুণদের সঙ্গে সংঘর্ষে ৩০ জনেরও বেশি পুলিশ আহত হয়েছে। আত্মরক্ষায় গুলি চালাতে বাধ্য হয়েছে পুলিশ।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে এটি আসলেই কি জেন জি’র আন্দোলন? কিংবা শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও বাংলাদেশের আন্দোলনের সঙ্গে এর মেলবন্ধন রয়েছে কি-না।
দেশটির বিশিষ্টজনদের মন্তব্য, এটাকে জেন-জির আন্দোলন বলা যেতে পারে। অনশনরত দুই জনের শরীর খারাপ হওয়ার পর তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হলে জেন-জির একাংশ ক্ষুব্ধ হন। তারাই মূলত রাস্তায় নামেন। বিকেল ৪টার পর থেকে পরিস্থিতি শান্ত হয়। যদিও কারফিউ বহাল রাখা হয়েছে। সিআরপিএফের গুলি চালানো নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। তবে, এই আন্দোলনে যে জেন-জিই মূলত ছিল, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। দেশটির মিডিয়ার রিপোর্টে এই ঘটনাকে ‘যুবাদের আন্দোলন’ হিসেবে অভিহিত করা হয়।
অপরদিকে, রাজনৈতিক আবহে ভিন্ন অবস্থান বা মন্তব্যও পাওয়া গেছে। স্থানীয় বিজেপি নেতাদের দাবি, এটা জেন-জির আন্দোলন নয়। এই সহিংস আন্দোলনের পেছনে আসলে কংগ্রেসের মদদ রয়েছে। তারাই এই সার্বিক অস্থিরতা তৈরির নেপথ্যে কাজ করছে।
উল্লেখ্য, সোনম ওয়াংচুকসহ ১৫ জন গত ১০ সেপ্টেম্বর থেকে চার দফা দাবিতে অনশন করছিলেন। তারমধ্যে অন্যতম ছিল লাদাখকে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা দাবি। এছাড়া চাকরিতে কোটা চালু করার পাশাপাশি লেহ ও কার্গিলকে নিয়ে একটি লোকসভা আসন করার দাবিও জানান তারা।
/এমএইচআর