বিদ্যুতের বিকল্প হিসেবে সৌরবিদ্যুৎ, মোমবাতি থেকে শুরু করে হ্যারিকেন এবং ল্যাম্প দিয়ে কোনোভাবে দিনরাত পার করছেন বরিশালের নদীবেষ্টিত মেহেন্দীগঞ্জের কয়েক লাখ মানুষ। যাদের বাড়িতে সৌরবিদ্যুৎ আছে তারা কিছুটা নিশ্চিন্ত থাকলেও বেশির ভাগ মানুষ অন্ধকারে আছেন। মোবাইলে ফোনে চার্জ দিতে তারা বিভিন্ন স্থানে ছোটাছুটি করছেন। জেনারেটর দিয়ে চার্জ দেওয়া হচ্ছে মোবাইলে। এ সমস্যা দ্রুত সমাধানের দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
এদিকে, উপজেলা হাসপাতালের বেডে গরমে রোগীরা কাতরাচ্ছেন, কিন্তু কারও কিছু করার নেই। রোগীর স্বজনরা দিনরাত হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছেন। যাদের নিকটজন কাছে নেই, তারা বেশি দুরবস্থায় আছেন।
মেহেন্দীগঞ্জের বাসিন্দা সঞ্জয় কুমার গুহ বলেন, ‘মেহেন্দীগঞ্জবাসীর নির্ভরতা মোমবাতি এবং ল্যাম্প। তবে যাদের বাড়িতে সৌরবিদ্যুৎ আছে তারা কিছুটা হলেও ভালো আছেন। তবে সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে মোবাইলে চার্জ নিয়ে। এ জন্য বাজারে জেনারেটর চালিয়ে অর্থের বিনিময় মোবাইল চার্জ দিতে হচ্ছে। সেখানেও দীর্ঘ লাইন। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে উপজেলা হাসপাতালের রোগীদের। বিদ্যুৎ না থাকায় গরমে তারা আরও অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।
‘তবে যারা আর্থিকভাবে সচ্ছল তারা বরিশাল নিয়ে যাচ্ছেন রোগীদের। যাদের সামর্থ্য নেই তারা হাতপাখার বাতাস দিয়ে রোগীকে সুস্থ রাখার চেষ্টা চালাচ্ছেন। বিদ্যুতের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যেও দেখা দিয়েছে বিপর্যয়।’
আরইবির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী গোলাম রব্বানী জানিয়েছেন, বরিশালের ধর্মগঞ্জ নদীর তলদেশে প্রায় সাড়ে ৪ কিলোমিটার সাবমেরিন ক্যাবলের একটি অংশ কাটা পড়ায় মেহেদিগঞ্জের অর্ধলক্ষাধিক গ্রাহকের অন্তত তিন লাখ মানুষ গত পাঁচ দিন ধরে অন্ধকারে। পুরো উপজেলা ও সন্নিহিত এলাকার চিকিৎসা, শিক্ষা, শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যসহ উপজেলার প্রশাসনিক কার্যক্রমেও ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে এসেছে। পুরো উপজেলা জুড়ে চিকিৎসা কার্যক্রম প্রায় মুখথুবড়ে পড়েছে।
তিনি আরও জানান, মঙ্গলবার দুপুরের পরে একটি পণ্যবাহী নৌযান ধর্মগঞ্জ নদীতে রাত্রীযাপনের জন্য নোঙর করলে তা গিয়ে পড়ে বরিশাল-মেহেদিগঞ্জের ৩৩ কেভি সঞ্চালন লাইনের সাবমেরিন ক্যাবলের ওপর। এ সময় ক্যাবল বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে পুরো মেহেদিগঞ্জে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। প্রথমে সবাই নিয়মিত লোডশেডিং বা শাটডাউন মনে করে। দিন পেরিয়ে রাত হওয়ার পরে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, ট্রান্সমিশন লাইনই বন্ধ হয়ে গেছে। পল্লী বিদ্যুতের প্রকৌশলী ও টেকনিশিয়ানরা খোঁজাখুঁজি করে সাবমেরিন ক্যাবলের সমস্যা শনাক্ত করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেন।
এর পরপরই ২৭ আগস্ট সকাল থেকে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড এবং বরিশাল পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি ১-এর প্রকৌশলীরা পরিস্থিতি সামাল দিতে কাজ শুরু করলেও তাতে সামান্যতম অগ্রগতি হয়নি। দিনরাত চেষ্টা করেও খরস্রোতা ওই নদীর তলদেশের সাবমেরিন ক্যাবল উত্তোলন করতেই ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময় চলে যায়। ২৯ আগস্ট দুপুরের পরে একটি ক্যাবলের দুই প্রান্তের অংশ খুঁজে পেয়ে তা মেরামত শুরু হয়।
এ জন্য পিরোজপুর থেকে দক্ষ ডুবুরিও আনা হয়েছে। পাশাপাশি খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে সাবমেরিন ক্যাবলসহ আরও বিপুলসংখ্যক সরঞ্জামাদিও আনা হয়েছে মেহেদিগঞ্জ সংলগ্ন ধর্মগঞ্জ নদীর তীরে।
পল্লি বিদ্যুৎ ১-এর জেনারেল ম্যানেজার রফিকুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, নদীর তলদেশ থেকে নেওয়া বিদ্যুতের চারটি ক্যাবল কাটা পড়েছে। এরপর ওই ক্যাবলের ওপর পলি জমে যায়। পরবর্তী সময়ে ডুবুরি নামানো হলে চারটি ক্যাবলের মধ্যে একটির দুই প্রান্তের অংশ খুঁজে পাওয়া গেলে তা সংযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু বাকি তিনটি ক্যাবলের দুই প্রান্তের কোনও অংশই এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। ডুবুরিরা চেষ্টা চালাচ্ছেন ওই ক্যাবল উদ্ধারে। ওই তিনটি ক্যাবলের দুই প্রান্ত খুঁজে পাওয়া গেলে সহজেই বিদ্যুৎ সচল করা সম্ভব হতো। কিন্তু পলির কারণে তা খুঁজে বের করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে। যদি কোনোভাবেই খুঁজে পাওয়া না যায় তাহলে নতুন ক্যাবল প্রতিস্থাপন করা হবে। চেষ্টা চলছে দ্রুত বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার।
২০০৪ সালে প্রায় সাড়ে ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে নদীবেষ্টিত মেহেদিগঞ্জে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করেছিল পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড। এরপর এত বড় বিপর্যয় এই প্রথম।