খুলনায় সাংবাদিক ওয়াহেদ-উজ-জামান বুলুর মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন স্বজনরা। তাদের দাবি, এটি হত্যাকাণ্ড। নানা কারণে তিনি চাপে থাকলেও আত্মহত্যার কোনও কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না তারা।
বুলুর ছোট ভাই আনিছুজ্জামান দুলু বলেন, ‘ভাইয়ের মৃত্যু আসলে অস্বাভাবিক। হঠাৎ এভাবে আত্মহত্যা করতে পারেন না। মানসিক চাপে থাকলেও আত্মহত্যার মতো কোনও ঘটনা ঘটেনি। তাকে হত্যা করা হয়েছে। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত ঘটনা উদঘাটন করতে হবে। আমরা এই ঘটনার ন্যায়বিচার চাই।’
সোমবার (০১ সেপ্টেম্বর) বিকালে খুলনা প্রেসক্লাবের সামনে জানাজার আগে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি। পরে বিকাল ৩টার দিকে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
জানাজার আগে সংক্ষিপ্ত আলোচনায় খুলনা প্রেসক্লাবের আহ্বায়ক এনামুল হক বলেন, ‘বুলুর মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত করে প্রকৃত রহস্য উন্মোচন করার দাবি জানাচ্ছি। তার মৃত্যু নিয়ে আমাদেরও প্রশ্ন আছে।’
খুলনা সাংবাদিক ইউনিয়নের (কেইউজে) সভাপতি মহেন্দ্র নাথ সেন বলেন, ‘বুলু দীর্ঘদিন বিভিন্ন জাতীয় ও স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে কাজ করেছেন। তার মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানাচ্ছি।’
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, তিন ভাইয়ের মধ্যে বড় ছিলেন সাংবাদিক বুলু। মেজো ভাই সড়ক দুর্ঘটনায় কয়েক বছর আগে মারা যান। ছোট ভাই আনিছুজ্জামান দুলু ঢাকায় ব্যবসা করেন। নগরের শিববাড়ি মোড় সংলগ্ন ইব্রাহিম মিয়া রোডে তাদের পৈতৃক বাড়ি থাকলেও সেটি চার বছর আগে বিক্রি করা হয়। এরপর বুলু সোনাডাঙ্গা আবাসিক এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। প্রায় চার মাস আগে তার স্ত্রী নিখোঁজ হন। আজ ১ সেপ্টেম্বর থেকে বাগমারা এলাকায় নতুন বাসায় ওঠার কথা ছিল তার।
জানাজায় উপস্থিত বুলুর শ্যালক মাহবুব জামান বলেন, ‘আমার বোন গত ১১ মে থেকে নিখোঁজ রয়েছেন। এ নিয়ে সোনাডাঙ্গা থানায় জিডি করা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত বোনের সন্ধান পাইনি আমরা। এ অবস্থায় ভগ্নিপতির লাশ উদ্ধারের ঘটনায় আমরা উদ্বিগ্ন। আসলে তিনি আত্মহত্যা করেছেন, নাকি হত্যা করা হয়েছে; তা নিয়ে আমাদের সন্দেহ আছে। বিষয়টি তদন্ত করে মৃত্যুর রহস্য উদঘাটনের দাবি জানাচ্ছি আমরা।’
আনিছুজ্জামান দুলু বলেন, ‘ট্রেনের ধাক্কায় গত মাসে আহত হয়ে কিছুদিন হাসপাতালে ছিলেন ভাই। তখন আমি তাকে ঢাকায় আসতে বলেছিলাম। আসার কথা বললেও আর আসেনি। তেমন কোনও বিষয় আমাদের সঙ্গে শেয়ার করতো না। গত শনিবার রাতে শেষবার কথা হয়েছে। আমার কাছে এটা হত্যা মনে হচ্ছে। একটা ফোন তো অন্তত করবে বা একটা মেসেজ তো করবে যে ভাই আমার আর ভালো লাগছে না। সুস্থ একজন মানুষ হঠাৎ করে এভাবে মারা যেতে পারে না। তার চাকরিটা মনে হয় ঠিকমতো ছিল না। স্ত্রী নিখোঁজ হওয়ার পর মন খারাপ থাকতো। তবে কারও সঙ্গে শত্রুতা বা অন্য কোনও বিষয়ে আমাদের জানা নেই। শুনেছি সেতুর ওপর কারও সঙ্গে কথা কাটাকাটি হচ্ছিল। এরপর তাকে ঝাঁপ দিতে দেখেছেন সেখানকার লোকজন।’
বুলুর শ্যালকের স্ত্রী নুরনাহার পারভীন বলেন, ‘গত শুক্রবার ভাড়া করা নতুন বাসায় মালপত্র তুলেছিলেন তিনি। দুপুরে আমাদের বাসায় খেয়েছেন। এরপর যশোরে আত্মীয়ের বাড়ি গিয়েছিলেন। শনিবার বিকালেও আমাদের বাসায় এসে খাওয়া-দাওয়া করে যান। রবিবার সকালে নাশতা করে বেরিয়ে যান। এ সময় এক বোতল পানি ও একটা ক্যাপ চেয়ে নেন। দুপুরে ফোন করলে সেটি বন্ধ পাই। রাতে মৃত্যুর খবর শুনি।’
নুরনাহার পারভীন বলেন, ‘আমার ননদ (বুলুর স্ত্রী) নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে তিনি মানসিকভাবে অশান্তিতে ছিলেন। কান্নাকাটি করতেন, খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো করতেন না। এজন্য আমরা তাকে আমাদের কাছে থাকতে বলেছিলাম। তবে তিনি আত্মহত্যা করতে পারেন বলে বিশ্বাস করি না। ঘটনার তদন্ত করা দরকার।’
কেএমপি সদর থানার নৌ পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) মহিদুল হক বলেন, ‘রবিবার রাতে খবর পেয়ে সেতুর ২ নম্বর পিলারের বেসমেন্টের ওপর থেকে লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল। সুরতহালে দেখা গেছে মুখ থেঁতলানো, দুই হাত ও বাঁ পা ভাঙা। পরে লাশটি খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়। সেখানের সোমবার ময়নাতদন্ত শেষে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এটি হত্যা নাকি আত্মহত্যা, পুরো ঘটনার তদন্ত চলছে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পেলে মৃত্যুর রহস্য জানা যাবে।’
প্রসঙ্গত, রবিবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে খুলনার রূপসা নদীর ওপর নির্মিত খান জাহান আলী সেতুর ২ নম্বর সেতুর পিলারের বেসমেন্ট থেকে সাংবাদিক ওয়াহেদ-উজ-জামান বুলুর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। বুলু সংবাদ প্রতিদিনের সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার ও খুলনা প্রেসক্লাব এবং খুলনা সাংবাদিক ইউনিয়নের (কেইউজে) সদস্য ছিলেন। সোমবার দুপুরে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্তের পর বিকালে লাশ খুলনা প্রেসক্লাবে আনা হয়। সেখানে খুলনা প্রেসক্লাব, খুলনা সাংবাদিক ইউনিয়ন, খুলনা প্রেসক্লাব মাল্টিপারপাস কো অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে শেষ শ্রদ্ধা জানানো হয়। এরপর ক্লাবের সামনে জানাজা হয়। বিকাল ৪টার দিকে নগরের গোয়ালখালি কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

















