ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলায় চোর সন্দেহে এক যুবককে পিটুনি দেওয়ার পর তাকে পুলিশ হেফাজতে আটকে রাখার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এরপর চার দিন পার হলেও তাকে আদালতে তোলা হয়নি। পুলিশের হেফাজতেই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল রবিবার সন্ধ্যায় তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় করা মামলায় অস্থায়ী এক পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জকে সোমবার সকালে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়।
নিহত যুবকের নাম মো. আব্দুল্লাহ (২৭)। তিনি বাঞ্ছারামপুর উপজেলার তেজখালী ইউনিয়নের বাহেরচর গ্রামের মো. আবুল হোসেনের ছেলে। ২৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা থেকে ২৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা পর্যন্ত আব্দুল্লাহ নবীনগর উপজেলার ছলিমগঞ্জ অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্পে পুলিশ হেফাজতে ছিলেন বলে দাবি পরিবারের। সেখানে তার মৃত্যু হয়েছে বলে জানান স্বজনরা।
এ ঘটনায় রবিবার রাতে নিহতের বড় ভাই শাকিল মিয়া বাদী হয়ে ছলিমগঞ্জ অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ এসআই মো. মহিম উদ্দিনসহ চার জনের নাম উল্লেখ করে একটি মামলা করেন। মামলায় গ্রেফতার পুলিশ সদস্যের নাম মো. মহিম উদ্দিন। তিনি নবীনগরের ছলিমগঞ্জ অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ ও উপপরিদর্শক (এসআই)। মামলার এজাহারভুক্ত অপর তিন আসামি হলেন নবীনগর উপজেলার ছলিমগঞ্জের বাড়াইলের তবি মিয়া (৩৪), একই গ্রামের আল আমিন (৩২) ও বাঞ্ছারামপুরের বাহেরচরের আয়নাল হক (৩০)। এ ছাড়া অজ্ঞাতনামা আরও ২০ থেকে ২৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে এলাকায় চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। নিহতের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়।
পুলিশ ও পরিবার সূত্রে জানা যায়, ১৭ সেপ্টেম্বর দুপুরের দিকে ছলিমগঞ্জের বাড়াইল গ্রামের মুদি দোকানি তবি মিয়ার বাড়ির স্টিলের আলমারি থেকে নগদ ৫ লাখ ৩৭ হাজার টাকা চুরি হয়। এ ঘটনায় তবি মিয়ার আত্মীয় সিরাজুল ইসলাম থানায় একটি অভিযোগ দেন। ঘটনার একটি সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেন তবি মিয়ার পরিবারের সদস্যরা। সিসিটিভি ফুটেজে তারা দেখতে পান, মুখে মাস্ক পরা একজন বাড়িতে চুরি করেছেন। এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ২৩ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আব্দুল্লাহকে ছলিমগঞ্জ বাজারের সিএনজিস্ট্যান্ডের সামনে আটক করেন তবি মিয়া, আল আমিন, আয়নালসহ ২০ থেকে ২৫ জন। পরে তারা আব্দুল্লাহকে রাস্তায় ও পরে বাড়িতে নিয়ে পিটুনি দেন। তবি মিয়ার বাড়িতে আটকে রেখে আব্দুল্লাহকে নির্যাতন করে প্লাস দিয়ে তার হাতে ও কপালের চামড়া উঠিয়ে ফেলা হয়। একপর্যায়ে ছলিমগঞ্জ অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ মাহিম উদ্দিনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পরে স্থানীয় একটি হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে পুলিশ ক্যাম্পে নেওয়া হয়।
পরিবারের অভিযোগ, এসআই মহিম উদ্দিন ও তার লোকজন বিষয়টি কাউকে কিছু না জানিয়ে আব্দুল্লাহকে অবৈধভাবে ছলিমগঞ্জ অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্পে আটকে রেখে নির্যাতন করেন। পুলিশের নির্যাতনে আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন। রবিবার বিকালে ছলিমগঞ্জ অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্পের সদস্যরা আব্দুল্লাহকে ছলিমগঞ্জ অলিউর রহমান (প্রা.) হাসপাতালে নিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা দেন। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে চিকিৎসক ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেন। রবিবার সন্ধ্যায় মৃত্যু হয় তার।
সোমবার বিকালে লাশের সুরতহাল প্রস্তুত করেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সহকারী কমিশনার প্রিন্স সরকার। তিনি জানান, নিহত যুবকের কপাল, দুই হাতসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে জখম পাওয়া গেছে।
নিহতের মামাতো ভাই আইনজীবী আল মামুন বলেন, বর্তমান আইন অনুসারে একজন আসামিকে ১২ ঘণ্টার বেশি পুলিশ হেফাজতে আটক রাখা যায় না। সেখানে আদালতে না পাঠিয়ে চার দিন পুলিশ হেফাজতে রেখে নির্যাতন করা হয়েছে।
আব্দুল্লাহর বড় ভাই শাকিল মিয়া বলেন, ‘চুরির অভিযোগে আমার ভাইকে পিটুনি দেওয়া হয়। ভাইয়ের পায়ে সুই ঢুকিয়েছে। প্লাস দিয়ে কপালের চামড়া তুলেছে। পরে গত বুধবার থেকে সলিমগঞ্জ পুলিশ ক্যাম্পে ছিল আমার ভাই। সেখানে তাকে আটকে রেখে নির্যাতন করেছে পুলিশ। পুলিশ বাড়িতে এসে আমাদের খোঁজখবর নিয়েছে। পুলিশের হয়রানির কারণে স্ত্রী, বাবা, বোন ও ভাই বাড়িতে থাকতে পারেনি।’
মামলার বিবরণে উল্লেখ করা হয়, পুলিশ ক্যাম্পে আব্দুল্লাহকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে পরিকল্পিতভাবে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। এতে তার মৃত্যু হয়েছে।
মৃত্যুর খবর শুনে স্থানীয় লোকজন ক্ষুব্ধ হয়ে সোমবার সকালে ছলিমগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়ি ঘেরাও করে বিক্ষোভ করেন। উত্তেজনা বাড়তে থাকায় পুলিশ প্রশাসন ফাঁড়িটি বন্ধ করে দেয় এবং সেনাসদস্য মোতায়েন করে। একইসঙ্গে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে স্থানীয় লোকজনকে শান্ত থাকতে বলেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) মো. ওবায়দুর রহমান বলেন, ‘যুবকের মৃত্যুর ঘটনায় এসআই মহিম উদ্দিনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। সকালে তাকে গ্রেফতার করা হয়। বিকালে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। এ ঘটনায় জড়িত অন্যদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে।’
জেলা পুলিশ সুপার মো. এহতেশামুল হক বলেন, ‘ওই যুবককে ক্যাম্পে অবৈধভাবে আটক রাখা হয়েছিল এবং নির্যাতন করা হয়েছিল বলে আমরা মনে করছি। বিভিন্ন সময় তাকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। সেই সিসিটিভি ফুটেজ আমাদের কাছে আছে। ওই পুলিশ সদস্যের ঘটনায় সংশ্লিষ্টতা আছে বলে মনে হচ্ছে আমাদের। এজন্য গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।’