বাংলার প্রতিটি জেলারই রয়েছে নিজস্ব খাবার ও সংস্কৃতির স্বাদ। ময়মনসিংহ অঞ্চলের নেত্রকোনার গর্ব ‘বালিশ মিষ্টি’ সেই তালিকায় এক অদ্ভুত ব্যতিক্রম। নাম শুনেই মনে হয়, বালিশ দিয়ে আবার মিষ্টি হয় নাকি! কিন্তু যারা একবার এর স্বাদ নিয়েছেন, তাদের মুখে এই মিষ্টির তুলনা নেই। ছোট্ট এক টুকরো বালিশের মতো লম্বাটে, নরম আর তুলতুলে এই মিষ্টি যেন মুখে গেলেই মিলিয়ে যায়।
সম্প্রতি এই ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি পেয়েছে দেশের ভৌগোলিক নির্দেশক (Geographical Indication-GI) পণ্যের মর্যাদা। দেশের ৫৮তম জিআই পণ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়ায় এখন এটি কেবল একটি স্থানীয় খাবার নয়, বরং জাতীয় ঐতিহ্যের অংশ হয়ে উঠেছে।
উৎপত্তির গল্প: এক শতাব্দীর ঐতিহ্য
তথ্য অনুযায়ী, ১৯৪৭ সালের আগে তৎকালীন কালীগঞ্জ শহরে বারহাট্টা রোডে স্থানীয় মিষ্টান্ন প্রস্তুতকারক গয়ানাথ ঘোষ প্রথমবারের মতো তৈরি করেছিলেন এই অদ্ভুত আকারের মিষ্টি। সাধারণ সন্দেশ বা রসগোল্লা থেকে একেবারেই আলাদা, আর সেই ব্যতিক্রমী আকৃতির কারণেই এর নাম হয় ‘বালিশ মিষ্টি’।
নেত্রকোনা শহরের প্রথম দিকে এই মিষ্টি বানানো হতো সীমিত পরিসরে, পরিবারের সদস্য ও ঘনিষ্ঠ মহলে। কিন্তু ধীরে ধীরে এটি নেত্রকোনার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে অপরিহার্য হয়ে ওঠে। বিয়ে-শাদি, পূজা-পার্বণ বা বিশেষ কোনও অনুষ্ঠান—সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দুতে জায়গা করে নেয় বালিশ মিষ্টি।
গয়ানাথ ঘোষের পরিবার দেশভাগের সময় ভারতে চলে গেলেও তিনি নেত্রকোনাতেই থাকেন। পরবর্তীতে বার্ধক্যজনিত কারণে ১৯৬৯ সালে তিনি দোকানটি কুমুদ চন্দ্র নাগকে বিক্রি করেন। এরপর কুমুদ চন্দ্র নাগ দোকানটি নিখিল মোদককে বিক্রি করেন, তবে দোকানের নাম গয়নাথেরই থেকে যায়।
ঐতিহ্যবাহী বালিশ মিষ্টি নিয়ে কবি ও সাহিত্যিকদেরও লেখা রয়েছে। গয়ানাথ ঘোষ শখের বসে কোলাকৃতি বালিশের মতো মিষ্টি তৈরি করেছিলেন। জেলা শহরের অজহর রোডে তার ছোট্ট দোকান ছিল, যেখানে প্রচলিত প্রায় সব ধরনের মিষ্টি বানাতেন। তবে এই মিষ্টির স্বাদ এবং আকৃতির কারণে এটি আলাদা পরিচিতি পায়।
বর্তমানে গয়নাথ ঘোষের নামেই আদি দোকান ছাড়াও শ্রী কৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভান্ডার, দুর্গা কেবিন, খান মিষ্টান্ন ভান্ডার, মুক্তি মিষ্টান্ন ভান্ডারসহ শহরের অন্যান্য দোকানেও বালিশ মিষ্টি পাওয়া যায়।
মূল উপকরণ হলো- দুধ, চিনি ও ছানা। দুধ থেকে তৈরি করা হয় ছানা, তারপর ছানা ও ময়দা দিয়ে মণ্ড তৈরি হয়, মণ্ড দিয়েই বানানো হয় বালিশ। সব শেষে চিনির রসে ভেজানো হয় এবং পরিবেশনের সময় দুধের ঘন মালাই প্রলেপ দেওয়া হয়।
স্বাভাবিক তাপমাত্রায় এই মিষ্টি ২-৩ দিন ভালো থাকে, শীতকালে থাকে ৭-৮ দিন পর্যন্ত। বর্তমানে শীতকালে ১-২ দিন স্থায়ী হয়। আকার অনুযায়ী দাম সর্বোচ্চ ১০০০ টাকা, সর্বনিম্ন ৩০ টাকা। এটি প্রথমে মাত্র ৫০ পয়সা দামে বিক্রি হতো।
প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে
আজ থেকে এক শতাব্দী আগে গয়ানাথ ঘোষ যে মিষ্টির সূচনা করেছিলেন, তা আজও ধরে রেখেছে তার পরিবার। বর্তমানে ‘গয়ানাথ মিষ্টান্ন ভান্ডার’ পরিচালনা করছেন তার নাতি বাবুল চন্দ্র মোদক।
বাবুল চন্দ্র মোদক আবেগভরা কণ্ঠে বলেন, ‘বালিশ মিষ্টি জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় আমরা গর্বিত। দাদার হাতে তৈরি মিষ্টি আজ জাতীয় গৌরবের প্রতীকে পরিণত হলো। ১৯৬৫ সাল থেকে আমার বাবা নিখিল চন্দ্র মোদক এই ব্যবসা সামলেছেন। এখন আমরা তিন ভাই মিলে তা চালাচ্ছি।’
এ যেন কেবল ব্যবসা নয়, এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে হস্তান্তরিত হওয়া এক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য।
কীভাবে তৈরি হয় বালিশ মিষ্টি
বালিশ মিষ্টির প্রস্তুত প্রক্রিয়া সাধারণ মিষ্টির মতো হলেও রয়েছে বিশেষ কিছু গোপন কৌশল। সাধারণত তাজা ছানা, চিনি ও দুধ এর মূল উপাদান। কিন্তু এর আকার ও ফোলাভাব তৈরি করতে যে কারিগরি দক্ষতা প্রয়োজন, সেটিই এই মিষ্টিকে আলাদা করেছে।
মিষ্টি বানাতে প্রথমে ছানা ও দুধ দিয়ে তৈরি হয় মণ্ড। তারপর তা হাতে লম্বাটে আকারে তৈরি করে দেওয়া হয়। মিষ্টির ভেতরে যেন থাকে তুলতুলে নরম ভাব—এই কৌশল প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে পারিবারিক গোপন রেসিপি হিসেবে রয়ে গেছে।
এই কারণে অন্য কোথাও অনুকরণ করার চেষ্টা হলেও নেত্রকোনার আসল বালিশ মিষ্টির স্বাদ পাওয়া যায় না।
মানুষের আবেগ ও সংস্কৃতিতে বালিশ মিষ্টি
নেত্রকোনার মানুষদের কাছে বালিশ মিষ্টি শুধু একটি খাবার নয়, এটি গর্বের প্রতীক। সামাজিক অনুষ্ঠান বা বিশেষ কোনও আয়োজন বালিশ মিষ্টি ছাড়া সম্পূর্ণ হয় না। দূর-দূরান্তের মানুষও বিশেষভাবে নেত্রকোনায় আসেন এই মিষ্টির স্বাদ নিতে।
বছরের পর বছর নেত্রকোনার পরিবারগুলো এই মিষ্টি উপহার হিসেবে পাঠিয়েছে আত্মীয়স্বজনদের কাছে। ফলে এটি হয়ে উঠেছে সম্পর্কেরও বাহক।
জিআই স্বীকৃতির যাত্রা
২০২৩ সালে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বালিশ মিষ্টির জিআই সনদের জন্য আবেদন করা হয়। এর জন্য প্রয়োজন ছিল বিস্তৃত তথ্য ও প্রমাণ—যেখানে তুলে ধরা হয় মিষ্টির উৎপত্তি, ইতিহাস, বৈশিষ্ট্য ও প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে হস্তান্তরের ধারাবাহিকতা।
যাচাই-বাছাইয়ের দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে ২০২৫ সালে পেটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেডমার্কস অধিদফতর (ডিপিডিটি) আনুষ্ঠানিকভাবে বালিশ মিষ্টিকে দেশের ৫৮তম জিআই পণ্য হিসেবে ঘোষণা করে।
প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গি
নেত্রকোনা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ জামান বলেন, ‘এর আগে দুর্গাপুরের বিজয়পুরের সাদামাটি জিআই সনদ পেয়েছিল। এবার বালিশ মিষ্টি যুক্ত হওয়ায় নেত্রকোনাবাসীর গর্ব আরও বেড়ে গেলো। আমরা এটিকে জেলার ব্র্যান্ডিং হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত করতে কাজ করবো।’
ঐতিহ্যের গৌরব
জিআই সনদ কেবল একটি প্রমাণপত্র নয়, এটি একটি ঐতিহ্যকে বৈশ্বিক স্বীকৃতি দেওয়ার প্রতীক। বালিশ মিষ্টির মতো একটি স্থানীয় খাবার এখন জাতীয় গর্বে পরিণত হওয়ায় নেত্রকোনার মানুষের মধ্যে নতুন করে উচ্ছ্বাস সৃষ্টি হয়েছে।
শতবর্ষ আগে জন্ম নেওয়া এই মিষ্টি আজ শুধু স্বাদের সীমায় আটকে নেই—এটি এক ঐতিহাসিক পরিচয়, সাংস্কৃতিক প্রতীক এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃত ঐতিহ্য।
নেত্রকোনার মানুষ এখন গর্বের সঙ্গে বলতে পারেন, তাদের হাতে শুধু একটি মিষ্টির স্বাদ নয়, বরং এক শতবর্ষের ঐতিহ্যের ইতিহাস ও জাতীয় স্বীকৃতি। বালিশ মিষ্টি আজ বাংলাদেশের গর্ব, আর আগামী দিনে এটি হয়তো দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্ব দরবারে পরিচিত হবে বাংলার এক অনন্য মিষ্টি হিসেবে।