Swadhin News Logo
সোমবার , ২০ অক্টোবর ২০২৫ | ৮ই কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
  1. best
  2. cassinoBR
  3. আন্তর্জাতিক
  4. কৃষি ও প্রকৃতি
  5. ক্যাম্পাস
  6. খেলাধুলা
  7. চাকরি
  8. জাতীয়
  9. জোকস
  10. তথ্যপ্রযুক্তি
  11. দেশজুড়ে
  12. ধর্ম
  13. নারী ও শিশু
  14. প্রবাস
  15. বই থেকে

ডেঙ্গুর ঢেউ জানুয়ারি পর্যন্ত থাকবে, নিয়ন্ত্রণ আরও কঠিন করে তুলবে

প্রতিবেদক
Nirob
অক্টোবর ২০, ২০২৫ ৮:১৫ পূর্বাহ্ণ
ডেঙ্গুর ঢেউ জানুয়ারি পর্যন্ত থাকবে, নিয়ন্ত্রণ আরও কঠিন করে তুলবে

বাংলাদেশে ডেঙ্গু এখন মৌসুমি রোগের সীমা পেরিয়ে ভয়াবহ জনস্বাস্থ্য সংকটে পরিণত হয়েছে। ঢাকায় যেমন রোগীর চাপ বাড়ছে, তেমনি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। আগের বছরগুলোর তুলনায় রোগী বেড়েছে কয়েক গুণ। ডেঙ্গুর বিস্তার ও প্রতিরোধ নিয়ে চলছে আলোচনা। এ অবস্থায় সংক্রমণ, বিস্তার ও প্রতিরোধ নিয়ে কথা বলেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও মশাবাহিত রোগ বিষয়ক গবেষক কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার।

বাংলা ট্রিবিউন: ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার সংক্রমণ দিন দিন বাড়ছে, এর মূল কারণ কী বলে মনে করেন?

ড. কবিরুল বাশার: ডেঙ্গু এখন জাতীয় এক গভীর সংকটের নাম। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এটি মৌসুমের সীমা ভেঙে বছরব্যাপী আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠেছে। বর্ষা ও বর্ষা-পরবর্তী সময়ে ডেঙ্গুর বিস্তার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যায়, কারণ তখনই এডিস মশার প্রজনন বেড়ে যায়। আমাদের গবেষণা বলছে, এ বছর লার্ভাযুক্ত পানির পাত্রের সংখ্যা বিপজ্জনকভাবে বেড়েছে। ফুলের টব, ড্রাম, কলস, নির্মাণাধীন ভবনের পানি কিংবা প্লাস্টিক বোতলের মতো জায়গায় বিপুল পরিমাণ লার্ভা জন্ম নিচ্ছে। আর প্রতি কনটেইনারে লার্ভার সংখ্যাও আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে—অর্থাৎ একেকটি উৎস থেকেই এখন অনেক বেশি মশার উৎপাদন হচ্ছে। চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু দুটিই এডিস মশার মাধ্যমে ছড়ায়, তাই এই প্রজনন বৃদ্ধিই রোগ দুটির বিস্তারকে একসঙ্গে বাড়িয়ে দিচ্ছে। এজন্য সবার আগে এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্রগুলো ধ্বংস করতে হবে।

বাংলা ট্রিবিউন: একসময় ডেঙ্গু শুধু ঢাকা শহরেই সীমাবদ্ধ ছিল। এখন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার কারণ কী?

ড. কবিরুল বাশার: আগে ডেঙ্গু মূলত শহরমুখী রোগ ছিল। কিন্তু এখন এটি উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। এখনকার গ্রামগুলো আগের মতো নেই—প্রায় সব এলাকাই কমবেশি নগরায়িত হয়ে পড়েছে। যখন ব্যাপক নগরায়ণ ঘটে এবং নিরবচ্ছিন্ন পানি সরবরাহের ব্যবস্থা থাকে না, তখন মানুষ ঘরে বা আশপাশে বালতি, টব, ড্রামসহ বিভিন্ন পাত্রে পানি জমিয়ে রাখে। এই জমে থাকা পানিতেই এডিস মশার প্রজনন হয়। এডিস মশা এক শহর থেকে আরেক শহর কিংবা গ্রামে বাস, লঞ্চ, ট্রাকসহ বিভিন্ন যানবাহনের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে। যেখানে এরা উপযুক্ত প্রজনন ক্ষেত্র পায়, সেখানেই তাদের বংশবিস্তার শুরু হয়।

এর দুটি বড় কারণ রয়েছে। প্রথমত, দেশের অভ্যন্তরীণ যাতায়াত ও জনসংখ্যা স্থানান্তর উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে গেছে। ফলে এক অঞ্চল থেকে অন্যত্র ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ছে। দ্বিতীয়ত, গ্রামীণ এলাকায় মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম প্রায় অনুপস্থিত। তাই একবার এডিস মশা প্রবেশ করলে তা দ্রুত বিস্তার লাভ করে। আমাদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, বর্তমানে আক্রান্তদের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ নগরবাসী হলেও গ্রামীণ এলাকায় সংক্রমণের হার দ্রুত বাড়ছে। এই প্রবণতা ভবিষ্যতে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণকে আরও কঠিন করে তুলবে।

বাংলা ট্রিবিউন: এ বছর ডেঙ্গুর সংক্রমণ এত দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার কারণ কী? শীতকালেও কী এর প্রভাব দেখা যাবে?

ড. কবিরুল বাশার: এ বছর ডেঙ্গুর ঢেউ জানুয়ারি পর্যন্ত থাকবে। এবার শীতকালেও প্রকোপ দেখা যাবে। কারণ, অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত। আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাস বলছে, ১০ দিন পর আরও একটি বৃষ্টির বলয় থাকবে। ওই বৃষ্টির ফলে যে মশার সৃষ্টি হবে, তারই পরিপ্রেক্ষিতে এবার শীতেও ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেবে বলে আশঙ্কা করছি। এজন্য সচেতনতার অভাব, সিটি করপোরেশন এবং সংশ্লিষ্টদের অবহেলাই মূলত দায়ী।

বাংলা ট্রিবিউন: ডেঙ্গুর ধরন পাল্টেছে, এডিস মশার আচরণও নাকি বদলে গেছে—বিষয়টি সত্যি?

ড. কবিরুল বাশার: হ্যাঁ, এটি সত্যি। আগে এডিস মশা সাধারণত দিনে কামড় দিতো, কিন্তু এখন অনেক ক্ষেত্রে সন্ধ্যার পরও কামড় দিচ্ছে। এটি তার আচরণগত পরিবর্তন, যা শহুরে জীবনযাত্রা ও আবহাওয়াগত পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত। অন্যদিকে ভাইরাসের জিনগত পরিবর্তনের কারণে সংক্রমণের ধরনও বদলেছে। আগে যেসব ভাইরাস স্ট্রেইন কম মারাত্মক ছিল, এখন তারা তুলনামূলক বেশি সংক্রমণক্ষম। ফলে রোগীর জটিলতা ও মৃত্যুহার দুটোই বেড়েছে।

বাংলা ট্রিবিউন: ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কেন আমরা ব্যর্থ হচ্ছি?

ড. কবিরুল বাশার: এখানে একাধিক কারণ রয়েছে। প্রথমত, মশক নিধন কার্যক্রম কার্যকর নয়। সিটি করপোরেশনের উদ্যোগ প্রায়ই কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকে। বিজ্ঞানভিত্তিক সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়নের ঘাটতি আছে। দ্বিতীয়ত, জনগণের সচেতনতার অভাব প্রকট। বহু পরিবার এখনও পানি জমে থাকা প্রতিরোধে উদাসীন। তৃতীয়ত, বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব—স্বাস্থ্য অধিদফতর, স্থানীয় সরকার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও জনগণ একসঙ্গে কাজ করছে না। এই তিনটি বিষয়ই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আমাদের ব্যর্থতার মূল কারণ। এখনই সচেতন না হলে সামনে আছে বড় বিপদ।

বাংলা ট্রিবিউন: তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে ডেঙ্গু সংক্রমণ বেশি দেখা যাচ্ছে, এর পেছনে কী কারণ দেখেন?

ড. কবিরুল বাশার: সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে ১৬ থেকে ৩০ বছর বয়সীরা। তারা দেশের শিক্ষার্থী ও কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী। তারা বাইরে বেশি সময় কাটায়, অফিস, বিশ্ববিদ্যালয় বা মাঠে থাকে—যেখানে মশার প্রজননস্থল বেশি। ফলে ঝুঁকিও বেশি। এতে একদিকে পরিবারগুলো অকাল শোকের মুখোমুখি হচ্ছে, অন্যদিকে শিক্ষা ও অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শিক্ষাজীবন ব্যাহত হচ্ছে, কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিতি বাড়ছে, চিকিৎসা ব্যয়ের চাপও বাড়ছে।

বাংলা ট্রিবিউন: ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে এখন সবচেয়ে বড় করণীয় কী?

ড. কবিরুল বাশার: সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—এখনই সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। লার্ভার উৎস ধ্বংস ছাড়া ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব। সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় প্রশাসনের মশক নিধন কর্মসূচি যেন নিয়মিত এবং বৈজ্ঞানিকভাবে হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। শুধু প্রাপ্তবয়স্ক মশা মারলে হবে না, প্রজননস্থল ধ্বংস করাই মূল কাজ। আমাদের গবেষণায় পাওয়া প্রযুক্তি—যেমন অটো-ডিসেমিনেশন ট্র্যাপ বা জৈব নিয়ন্ত্রণ—মাঠ পর্যায়ে দ্রুত প্রয়োগ করা প্রয়োজন। এ ছাড়া কেবি মডেল বাস্তবায়ন করা উচিত বলে আমি মনে করি। এসব বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করলে স্বল্প সময়ে মশার ঘনত্ব অনেক কমানো সম্ভব।

বাংলা ট্রিবিউন: জনসচেতনতার অভাবের কথা আপনি আগেও বলেছিলেন। মানুষকে সচেতন করতে কীভাবে কাজ করা যেতে পারে?

ড. কবিরুল বাশার: জনগণকে এই লড়াইয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে আনতে হবে। প্রত্যেক পরিবারকে বুঝতে হবে—এডিস মশার জন্মস্থল ধ্বংস করা কেবল সরকারের নয়, তাদের ব্যক্তিগত দায়িত্বও। প্রতি সপ্তাহে অন্তত একদিন ১০ মিনিট সময় দিয়ে বাড়ির ভেতর-বাইরে পানি জমে আছে কিনা, তা পরীক্ষা করার অভ্যাস করতে হবে। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মন্দির, এবং ধর্মীয় সংগঠনগুলোও এই প্রচারে যুক্ত হতে পারে। সচেতনতা তখনই ফলপ্রসূ হবে, যখন এটি সামাজিক দায়িত্ববোধে রূপ নেবে।

বাংলা ট্রিবিউন: সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব কতটা সমস্যা তৈরি করছে বলে মনে করেন?

ড. কবিরুল বাশার: এটাই মূল বাধা। স্বাস্থ্য অধিদফতর, স্থানীয় সরকার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও পরিবেশ অধিদফতর—এই চারটি সংস্থা একসঙ্গে না চললে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। একটি সংস্থা ওষুধ ছিটায়, অন্যটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকে তদারকি করে, কিন্তু তাদের মধ্যে নিয়মিত তথ্য বিনিময় বা যৌথ পরিকল্পনা নেই। এখন সময় এসেছে একটি কেন্দ্রীয় টাস্কফোর্স গঠনের, যেখানে সবাই একসঙ্গে সিদ্ধান্ত নেবে এবং কাজ করবে। এই টাস্কফোর্সের নেতৃত্ব হতে হবে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে।

বাংলা ট্রিবিউন: এই পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কতটা প্রস্তুত আছে?

ড. কবিরুল বাশার: সরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিন রোগীর চাপ বাড়ছে, কিন্তু শয্যা ও চিকিৎসক—নার্সের সংখ্যা সীমিত। রক্ত, প্লাজমা বা প্লাটিলেটের অভাব থাকলে চিকিৎসা জটিল হয়ে যায়। তাই এখনই জেলা ও উপজেলা হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু চিকিৎসার ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। ঢাকায় আসার প্রবণতা কমাতে হলে স্থানীয় পর্যায়ে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করাই সরকারের একমাত্র পথ।

বাংলা ট্রিবিউন: আপনি বলছেন, ডেঙ্গু একটি জাতীয় সংকট। একটু ব্যাখ্যা করবেন?

ড. কবিরুল বাশার: হ্যাঁ, ডেঙ্গুকে আমরা শুধুমাত্র চিকিৎসা বিষয়ক সমস্যা হিসেবে দেখলে ভুল হবে। এটি এখন সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং প্রশাসনিক সংকটে রূপ নিয়েছে। একজন কর্মক্ষম মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে পুরো পরিবার বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। চিকিৎসা ব্যয়, কর্মক্ষমতা হ্রাস এবং মানসিক চাপ—সব মিলিয়ে এটি দেশের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলছে। তাই এখন আমাদের দায়সারা মনোভাব থেকে বের হয়ে বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে। স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকার, শিক্ষা, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও জনগণ—সবাইকে একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে।

বাংলা ট্রিবিউন: সামনের শীত মৌসুমে কী ধরনের পরিস্থিতির আশঙ্কা করছেন?

ড. কবিরুল বাশার: অক্টোবর হচ্ছে পরীক্ষার মাস। এখন এডিস মশার ঘনত্ব ডেঙ্গু বিস্তারের উপযোগী মাত্রায় রয়েছে। যদি কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আক্রান্তের সংখ্যা বেশি হতে পারে। অতএব, এখনই উদ্যোগ নিতে হবে—না হলে কয়েক সপ্তাহ পর হয়তো অনেক দেরি হয়ে যাবে।

বাংলা ট্রিবিউন: দেশের মানুষের জন্য আপনার বার্তা কী?

ড. কবিরুল বাশার: ডেঙ্গু প্রতিরোধ শুরু হয় আমাদের ঘর থেকেই। আমরা যদি নিজ নিজ বাড়ি, অফিস, স্কুল বা নির্মাণাধীন জায়গায় পানি জমতে না দিই, তাহলে অর্ধেক যুদ্ধ জিতে যাওয়া সম্ভব। একজন সচেতন নাগরিকের সামান্য উদ্যোগই একটি জীবন বাঁচাতে পারে, এই উপলব্ধিটিই এখন সবচেয়ে জরুরি।

বাংলা ট্রিবিউন: আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ বাংলা ট্রিবিউনকে সময় দেওয়ার জন্য।

ড. কবিরুল বাশার: বাংলা ট্রিবিউনকেও ধন্যবাদ।

সর্বশেষ - আন্তর্জাতিক