ময়মনসিংহে ডেঙ্গু এখন মৌসুমি রোগ নয়; প্রায় বছরব্যাপী আক্রান্ত হচ্ছেন মানুষজন। চলতি বছর আক্রান্তের সংখ্যা দেড় হাজার ছাড়িয়ে গেছে। তাদের মধ্যে ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিসংখ্যান বলছে, সর্বশেষ শনিবার সকাল ৮টা থেকে রবিবার (০২ নভেম্বর) সকাল ৮টা পর্যন্ত ময়মনসিংহ বিভাগে ৮৭ জন আক্রান্ত হয়েছেন। এ অবস্থায় ময়মনসিংহকে ডেঙ্গুর নতুন হটস্পট বলছেন স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা।
সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, মশা মারার ব্যাপারে সিটি করপোরেশন গাছাড়া ভাবে চলে এসেছিল। এতে প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ায় গত ২০ অক্টোবর থেকে মশা নিধনের ক্র্যাশ প্রোগ্রাম শুরু করে তারা। তবে বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় পরিকল্পনা কম। এরই মধ্যে বিভিন্ন এলাকায় মশার উপদ্রব বেড়ে গেছে।
নগরের বাসিন্দারা বলছেন, ময়মনসিংহ নগরে দিন দিন বেড়েই চলছে এডিস মশার প্রকোপ। এতে মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। পাশাপাশি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। সিটি করপোরেশন মশা নিধন ও নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না। মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ নগরের অনেক এলাকার বাসিন্দারা। এ অবস্থায় অনেকের মধ্যে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা কাজ করছে।
ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ২২ অক্টোবর হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আনোয়ারুল হকের (৭২) মৃত্যু হয়। তিনি নগরের নতুন বাজার এলাকার বাসিন্দা ছিলেন। সর্বশেষ ২ নভেম্বর সন্ধ্যা পর্যন্ত ডেঙ্গু ওয়ার্ডে ৭৭ জন ভর্তি আছেন। এর মধ্যে পুরুষ ৬৪ জন, নারী নয় জন এবং শিশু চার জন। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত এক হাজার ৫৬০ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন। তাদের মধ্যে ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। বাকিরা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। অনেকে চিকিৎসাধীন।
ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. মো. জাকিউল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডে দিন দিন ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে। চিকিৎসক ও নার্সরা চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন। তবে মশা নিধনে সিটি করপোরেশনকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ডাবের খোসাসহ বিভিন্ন ধরনের ময়লা-আবর্জনায় এডিস মশা জন্মায়। কোথাও তিন দিনের বেশি পানি জমে থাকলে সেখানে এডিস মশা জন্মাতে পারে। এই মশা থেকেই ছড়ায় ডেঙ্গু রোগ। এ অবস্থায় আবদ্ধ পানিতে কীটনাশক প্রয়োগ কিংবা চলাচলের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। এডিস মশার প্রজননক্ষেত্রগুলো ধ্বংস করতে হবে।’
নগরের একাধিক বাসিন্দা জানিয়েছেন, জমে থাকা পানিতে মশা ও মশার লার্ভা জন্মানোর দৃশ্য বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতাই ফুটে উঠছে। বিশেষ করে মশা নিধন ও নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না সিটি করপোরেশন। নিয়মিত মশার ওষুধ ছিটানো এবং লার্ভা ধ্বংসের কার্যক্রম দেখছেন না তারা। মশার কামড়ে সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত ঘরে থাকা দায় হয়ে পড়েছে। নগরের বাসাবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত- কোথাও রেহাই নেই। মশার উপদ্রবে একপ্রকার অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন তারা।
নগরবাসী বলছেন, নিয়মিত মশার ওষুধ ছিটানো এবং লার্ভা ধ্বংসে অভিযান চালাতে হবে। ড্রেন ও নালা পরিষ্কারের কাজ জোরদার করতে হবে। প্রতিটি ওয়ার্ডে লার্ভা নিধন কার্যক্রম নিশ্চিত করতে হবে। মশা নিধনে কার্যকর ও দীর্ঘমেয়াদি সমাধান চান তারা। না হয় সামনের দিনগুলোতে আক্রান্ত রোগী আরও বাড়বে।
নগরের ভাটিকাশর এলাকার আরিফুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সন্ধ্যার পর মশার কামড়ে ঘরে বসে থাকা যায় না। কয়েল জ্বালিয়ে, মশা মারার ইলেকট্রিক ব্যাট ব্যবহার করেও মশা কমানো যাচ্ছে না। শিশুরা পড়াশোনায় বসতে পারে না। রাতে ঠিকমতো ঘুমাতেও পারে না। একেবারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি আমরা।’
সিটি করপোরেশন মশা নিধন ও নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না বলে জানিয়েছেন চরপাড়া কপিক্ষেত এলাকার বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ আমরা। এ অবস্থায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা কাজ করছে। ড্রেন, খালবিল, ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়গুলো মশার প্রজননকেন্দ্র হয়ে উঠেছে। এসব প্রজননকেন্দ্র ধ্বংসের জন্য সিটি করপোরেশনের যেসব পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, তা নিচ্ছে না। কিছু এলাকায় ফগার মেশিন দিয়ে ধোঁয়া ছড়ানো শুরু হয়েছে। ধোঁয়া ছড়ানোর পরও কোনও কাজে আসছে না। মশা কিন্তু মরছে না। বরং ফগার মেশিনের বিকট শব্দে এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে মশা। এতে মশার উৎপাত বন্ধ না হওয়ায় ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন আছে।’
একই এলাকার বাসিন্দা ফরিদা বেগম বলেন, ‘মশার যন্ত্রণায় বাসায় থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর মশার উৎপাত কয়েকগুণ বেড়ে যায়। দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।’
তবে সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব যাতে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায়, সেজন্য তারা সক্রিয় আছেন। মশা নিধনের জন্য একাধিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছেন। গত ২০ অক্টোবর থেকে নগরে মশা নিধনের ক্র্যাশ প্রোগ্রাম শুরু হয়েছে। সচেতনতামূলক বার্তা ও লিফলেট দেওয়া হচ্ছে। ড্রেনের ময়লা ও ঝোপঝাড় অপসারণসহ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম চলমান আছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মশক নিধনে বাজেট ধরা হয়েছে দেড় কোটি টাকা। ইতিমধ্যে অর্ধকোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে কার্যক্রমে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. এইচ কে দেবনাথ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মশা নিধনে আমাদের প্রয়োজনীয় কার্যক্রম চলমান আছে। তবে এর পাশাপাশি বাসাবাড়ির ছাদে বা টবে পানি জমিয়ে রাখা যাবে না। এ ছাড়া যেখানে-সেখানে আবর্জনা ফেলা যাবে না। এজন্য নগরের বাসিন্দাদেরও সচেতন হতে হবে। তখন ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে।’
এ বিষয়ে সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মো. মোখতার আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মশার লার্ভা মারার জন্য পর্যাপ্ত ওষুধ ছিটানো হচ্ছে। সিটি করপোরেশনের কর্মীরা মশা নিধনে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছেন। তবে জনগণের সচেতনতা ছাড়া এ পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব নয়।’

















