বায়ুদূষণে ২০২৪ সালে দেশ হিসেবে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। নগর হিসেবে বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ নগর ছিল ঢাকা। আগের বছর (২০২৩) এ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ শীর্ষে ছিল আর নগর হিসেবে ঢাকার অবস্থান ছিল দ্বিতীয়। এবার বায়ুদুষণে শীর্ষ দেশটি হলো আফ্রিকার দেশ চাদ। আর নগর হিসেবে শীর্ষে আছে ভারতের রাজধানী দিল্লি। সবমিলিয়ে বায়ুদূষণকে ‘নীরব ঘাতক’ বলা হচ্ছে। কারণ এটি ধীরে ধীরে মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে এবং হৃদরোগ, স্ট্রোক, ক্যানসারের মতো প্রাণঘাতী রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। ফলে বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ মানুষ মারা যায়। যার মধ্যে অনেক শিশুও আছে। এটি পরিবেশ ও জলবায়ুর ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।
বাংলাদেশে বায়ুদূষণ এখন বড় জনস্বাস্থ্য সংকটে পরিণত হয়েছে। ঢাকার বাতাস বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরগুলোর তালিকায় নিয়মিত শীর্ষে থাকে। দূষণের মাত্রা শীতকালে ভয়াবহ আকার ধারণ করে। আর রাতে দূষণ বেশি হয়। সম্প্রতি ঢাকার বাতাসে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ও অন্যান্য জীবাণুর সঙ্গে ছত্রাক পাওয়া গেছে। যা স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে ঢাকার বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষণ করে আসছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষক ড. শফি মুহাম্মদ তারেক। সম্প্রতি বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্স থেকে স্বর্ণপদকে ভূষিত এই বিজ্ঞানী তার গবেষণাগারে ১৬০টির বেশি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন। যা চার হাজার ৩০০ বারের বেশি উদ্ধৃত হয়েছে। বায়ুদূষণের বর্তমান অবস্থা, স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং সমাধান নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেছে বাংলা ট্রিবিউন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আসিফুল ইসলাম রিফাত।
বাংলা ট্রিবিউন: ঢাকার বায়ুদূষণের মাত্রা কোনোভাবেই কমছে না, কেন এমন হচ্ছে?
ড. শফি মুহাম্মদ তারেক: আমরা সবাই জানি কেন বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। দায়ী সংস্থাগুলো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে চাইছে না। আমাদের পর্যবেক্ষণ বলছে, বর্তমানে ঢাকায় ৩০-৪০ বছরের পুরোনো গাড়িও চলছে, যেগুলোর ফিটনেস নেই, লাইসেন্স নেই। উন্নত দেশে গাড়ি চার বছরের বেশি চালানো যায় না। কিন্তু আমরা বিদেশ থেকে সেসব পুরোনো গাড়ি কিনে এনে এখানে চালাই। মানে শুধু গাড়িই নয়, আমরা দূষণও আমদানি করছি। এজন্য নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
বাংলা ট্রিবিউন: আপনি দীর্ঘদিন বায়ুর মান নিয়ে গবেষণা করছেন, ধুলা ও বস্তুকণার বাইরে আপনার গবেষণায় অন্য কী উপাদান পাওয়া গেছে?
ড. শফি মুহাম্মদ তারেক: ধুলা তো আছেই, তবে আমরা সম্প্রতি ঢাকার বাতাসে ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক পেয়েছি। এগুলো হাঁচি-কাশির মাধ্যমে বাতাসে ছড়িয়ে ১০ থেকে ১০০ মিটার দূরে পৌঁছাতে পারে। যদি এসব জীবাণু খাবারে পড়ে, তাহলে পাকস্থলীতে গিয়ে মারাত্মক সংক্রমণ ঘটাতে পারে। তাই উন্মুক্ত খাবার খাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। এ ছাড়া কার্বন মনো অক্সাইড, ক্যাডমিয়াম, সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার পিএম ২.৫ (PM 2.5) এর মান অস্বাস্থ্যকর পর্যায়ে আছে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি।
বাংলা ট্রিবিউন: ঢাকায় কোন সময়ে বায়ুদূষণের মাত্রা সবচেয়ে বেশি থাকে?
ড. শফি মুহাম্মদ তারেক: বিশেষ করে সন্ধ্যার পর থেকে ভোর পর্যন্ত দূষণের মাত্রা বাড়তে থাকে। বিকাল ৪টার পর অফিস ছুটি হয়, তখন গাড়ির সংখ্যা বেড়ে যায়। রাত ৮টার পর ভারী ট্রাক ও নির্মাণসামগ্রীবাহী যানবাহন চলে। মধ্যরাতে অনেকে সড়কে ঝাড়ু দেওয়া শুরু করে, যা সকাল পর্যন্ত চলে। এ সময় পুরো শহরে ধুলা উড়তে থাকে। ফাঁকা রাস্তায় দ্রুতগতির কারণে সড়ক বিভাজকের ধুলা উড়ে বাতাসে মিশে যায়। এ ছাড়া রাতে দেখা যায় প্লাস্টিক পোড়ানো বেড়ে যায়। ফলে রাতের শহর দিনের তুলনায় বেশি দূষিত থাকে।
বাংলা ট্রিবিউন: আমাদের সচেতনতা কতটুকু দায়ী?
ড. শফি মুহাম্মদ তারেক: আমাদের সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণ বলছে, যেখানে-সেখানে ময়লা ফেলা, নিয়মিত প্লাস্টিক পোড়ানো বায়ুদূষণের জন্য অন্যতম দায়ী। শুষ্ক মৌসুমে এটি আরও ভয়াবহ হয়। বিষাক্ত গ্যাস ঢাকার বাতাসে মিশে মানুষের দেহে প্রভাব ফেলছে। যা শ্বাসকষ্ট ও দীর্ঘমেয়াদি ফুসফুস রোগের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
বাংলা ট্রিবিউন: স্বাস্থ্যঝুঁকির দিক থেকে বায়ুদূষণকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
ড. শফি মুহাম্মদ তারেক: ধীরে ধীরে এটি একটি নীরব ঘাতকে রূপ নেয়। ঠান্ডা, কাশি, অ্যাজমা থেকে শুরু করে ক্যানসারের ঝুঁকি তৈরি করছে। বাতাসে ভারী ধাতু যেমন সিসা ও ক্যাডমিয়াম বাড়ছে, যা ক্যানসারের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে বায়ুদূষণ।
বাংলা ট্রিবিউন: অন্য দেশগুলো দূষণ মোকাবিলায় কী করছে, যা আমাদেরও করা উচিত?
ড. শফি মুহাম্মদ তারেক: দূষণরোধে চীন, ভারত ও থাইল্যান্ড কঠোর নিয়ম করেছে। অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করেছে। রাস্তা পরিষ্কারে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। আমাদেরও সদিচ্ছা থাকলে একই কাজ করা সম্ভব।
বাংলা ট্রিবিউন: সমাধানের পথ কী?
ড. শফি মুহাম্মদ তারেক: উপায় সবারই জানা, প্রয়োগ খুবই ক্ষীণ। প্রথমে মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়িগুলোকে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করতে হবে। ইটভাটার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। নির্মাণকাজে ধুলা নিয়ন্ত্রণে বাধ্যতামূলক নিয়ম চালু করতে হবে। চীন, ভারত ও থাইল্যান্ড দেখিয়েছে যে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। বাংলাদেশও তা করতে পারে। এতে দূষণ অনেকটাই কমে আসবে।
বাংলা ট্রিবিউন: ইটভাটাগুলো কি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব?
ড. শফি মুহাম্মদ তারেক: অবশ্যই সম্ভব। এ ছাড়া আমরা দেখছি, অনুমতি ছাড়াই প্রতিদিন নতুন নতুন ভবন, কারখানা নির্মাণ হচ্ছে। এতে প্রচুর ইট, বালু, সিমেন্ট ও রং ব্যবহার হচ্ছে। যা বায়ুদূষণের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। শহরের অবকাঠামো পরিকল্পনায় দূষণ নিয়ন্ত্রণের নিয়মকানুন কার্যকর করা হয়নি।
বাংলা ট্রিবিউন: আপনার মতে এ নিয়ে গণমাধ্যমের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
ড. শফি মুহাম্মদ তারেক: অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গণমাধ্যম শুধু র্যাঙ্কিং দেখালেই হবে না, বরং স্বাস্থ্যঝুঁকি, কৃষি, জীববৈচিত্র্য ও অর্থনীতিতে বায়ুদূষণের প্রভাব নিয়মিতভাবে তুলে ধরতে হবে। তখনই নীতিনির্ধারকরা চাপ অনুভব করবেন। পাশাপাশি কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার কথাও ভাববেন।
বাংলা ট্রিবিউন: আপনি গবেষণায় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছেন। ব্যক্তিগতভাবে এই অর্জনকে কীভাবে দেখেন?
ড. শফি মুহাম্মদ তারেক: এটি দেশের জন্যই স্বীকৃতি। বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ একটি দেশে পরিবেশ গবেষণা করা কঠিন হলেও আমরা দেখাতে পেরেছি যে, বিজ্ঞান দিয়ে বাস্তব সমস্যার সমাধান সম্ভব। আমি সবসময়ই চাই, গবেষণা শুধু প্রবন্ধেই সীমাবদ্ধ না থেকে নীতিনির্ধারণের কাজে লাগুক।
বাংলা ট্রিবিউন: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
ড. শফি মুহাম্মদ তারেক: বাংলা ট্রিবিউনকেও ধন্যবাদ।
প্রসঙ্গত, ঢাকার বাতাসে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক বিভিন্ন রোগের কারণ হতে পারে। বায়ুদূষণের সঙ্গে এই জীবাণুগুলো ধুলিকণার সঙ্গে মিশে এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে। এই ব্যাকটেরিয়াগুলো ফুসফুস ও অন্যান্য অঙ্গের ক্ষতি করতে পারে। যা গুরুতর স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ।
ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার উৎস ও প্রভাব
স্ট্রেপ্টোকক্কাস নিউমোনিয়া, স্ট্রেপ্টোকক্কাস পাইজেনেস, মাইকোপ্লাজমা নিউমোনিয়া, হিমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা, ক্লেবসিয়েলা নিউমোনিয়া, সিউডোমোনাস অ্যারুগিনোসা এবং মাইকোব্যাকটেরিয়াম টিউবারকুলোসিসের মতো ব্যাকটেরিয়া বাতাসের মাধ্যমে ছড়াতে পারে। ভাইরাস: SARS-CoV-2, হাম, চিকেনপক্স এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের মতো কিছু ভাইরাসও বায়ুবাহিত হয়। এই জীবাণুগুলো শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসের সংক্রমণ এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
সমাধান ও প্রতিরোধ
বায়ুদূষণের উৎসগুলো, যেমন যানবাহনের ধোঁয়া, শিল্পকারখানা এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণ নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। ব্যক্তিগত সুরক্ষা হিসেবে বাইরে বের হওয়ার সময় মাস্ক পরা এবং জনসমাগমস্থলে মাস্ক ব্যবহার করা একটি ভালো অভ্যাস হতে পারে।
















