নানা আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের দুটি টার্মিনাল নিয়ে সোমবার (১৭ নভেম্বর) বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি সই হয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় কর্ণফুলী নদীর তীরে লালদিয়া টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনা নিয়ে একটি এবং ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জের পানগাঁও নৌ টার্মিনাল পরিচালনার বিষয়ে অন্য চুক্তিটি হয়। ওই দিন ঢাকার একটি হোটেলে আয়োজিত পৃথক দুই অনুষ্ঠানে চুক্তি দুটি সই হয়েছে। তবে স্বাক্ষরটা প্রকাশ্যে হলেও চুক্তিতে বিস্তারিত কী কী শর্ত রয়েছে এবং কী কী তথ্য প্রকাশ করা যাবে না, সেগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি।
যদিও নৌপরিবহন উপদেষ্টা বলেছেন, চুক্তির বিভিন্ন শর্তের বিষয়ে পরবর্তী সময়ে জানানো হবে। এদিকে চুক্তির বিরোধিতা করে ইতিমধ্যে বিভিন্ন পক্ষ বিক্ষোভ মিছিল, মশাল মিছিল ও বিবৃতি দিয়েছে। তবে বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছেন, বিদেশিদেরকে বন্দর দেওয়া হচ্ছে না। পরিচালনার জন্য অপারেটর নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।
এরই মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) বিদেশি কোম্পানির হাতে ছেড়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া এগিয়ে নিচ্ছে সরকার। আগামী ডিসেম্বরে সংযুক্ত আরব আমিরাতের কোম্পানি ডিপিওয়ার্ল্ডের সঙ্গে চুক্তির জন্য কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ১৬ নভেম্বর প্রকল্পের দরপত্র মূল্যায়নের জন্য ৭ সদস্যের একটি কমিটি গঠনের প্রস্তাব করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে এই কমিটির অনুমোদনের জন্য চিঠি দেন বন্দরসচিব ওমর ফারুক। প্রস্তাবিত কমিটিতে আহ্বায়ক করা হয়েছে বন্দর পর্ষদের সদস্য অতিরিক্ত সচিব মাহবুব আলম তালুকদারকে।
নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) ও চিটাগাং কনটেইনার টার্মিনালসহ (সিসিটি) চট্টগ্রাম বন্দরের স্থাপনা বিদেশি কোম্পানির কাছে না দেওয়ার দাবিতে বেশ কিছুদিন ধরে মশাল মিছিল ও সড়ক অবরোধ করেছে বন্দর রক্ষা পরিষদ। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় নগরের বড়পোল এলাকায় পোর্ট কানেকটিং সড়কে এ কর্মসূচি পালন করেন তারা। এ সময় সাময়িকভাবে যান চলাচল ব্যাহত হয়।
এদিকে, গত সোমবার (১৭ নভেম্বর) চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় কর্ণফুলী নদীর তীরে লালদিয়া টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনা নিয়ে একটি এবং ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জের পানগাঁও নৌ টার্মিনাল পরিচালনার বিষয়েও অন্য চুক্তিসহ মোট দুটি চুক্তি সই হয়। এর মধ্যে লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল নিয়ে করা চুক্তিতে সই করেন ডেনমার্কভিত্তিক এপিএম টার্মিনালসের ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্টেইন ভ্যান ডোঙ্গেন ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান। অন্যদিকে পানগাঁও নৌ টার্মিনালবিষয়ক চুক্তিতে সই করেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান ও মেডলগ বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ টি এম আনিসুল মিল্লাত। এখানেও নৌপরিবহন উপদেষ্টা উপস্থিত ছিলেন।
চুক্তি অনুসারে, চট্টগ্রাম বন্দরের লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ এবং ৩০ বছরের জন্য এটি পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে ডেনমার্কের এপি মোলার মায়ের্সক গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এপিএম টার্মিনালর্স। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) আওতায় এ টার্মিনাল নির্মাণের জন্য কোম্পানিটি ৫৫ কোটি ডলার বা প্রায় ৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে। চুক্তিটি স্বাক্ষরের পরপরই ২৫০ কোটি টাকা ‘সাইনিং মানি’ হিসেবে পেয়েছে বাংলাদেশ।
অন্যদিকে, ২২ বছরের জন্য ঢাকার কেরানীগঞ্জের পানগাঁও নৌ টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে সুইজারল্যান্ডের প্রতিষ্ঠান মেডলগ এসএ। এ টার্মিনালে মোট ৪ কোটি ডলার বা প্রায় ৪৯০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে মেডলগ। এ ক্ষেত্রে সাইনিং মানি হিসেবে তারা বাংলাদেশকে দিয়েছে ১৮ কোটি টাকা।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, লালদিয়া টার্মিনালে বছরে আট থেকে ১০ লাখ একক কনটেইনার ওঠানো–নামানোর সক্ষমতা থাকবে। এর মধ্যে আট লাখ পর্যন্ত প্রতি একক কনটেইনারে ২১ ডলার (প্রায় ২ হাজার ৫০০ টাকা) করে পাবে সরকার। আর আট লাখের বেশি কনটেইনার ওঠানো-নামানো হলে প্রতি একক কনটেইনারের জন্য পাবে ২৩ ডলার করে। অন্যদিকে পানগাঁও নৌ টার্মিনালে বছরে এক লাখ ৬০ হাজার একক কনটেইনার হ্যান্ডলিং হবে বলে জানিয়েছে মেডলগ। প্রতি একক কনটেইনার থেকে ২৫০ টাকা করে পাবে সরকার।
লালদিয়া টার্মিনালের চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে নৌপরিবহন উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘এই চুক্তি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে জাতির জন্য বড় অবদান। যাদের মধ্যে চুক্তি নিয়ে সন্দেহ ছিল, আশা করি তা দূর হবে।’
এ প্রসঙ্গে জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাধারণ সম্পাদক কাজী শেখ নুরুল্লাহ বাহার বলেন, ‘বিগত স্বৈরাচারী সরকারের সময়ে একতরফাভাবে নেওয়া সিদ্ধান্তকে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বহাল রেখেছে, এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। দেশের কৌশলগত সম্পদ বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার এই ষড়যন্ত্র কোনোভাবেই মেনে নেওয়া হবে না। শ্রমিকদের বেকার করে দেওয়ার, শ্রমিকদের পেটে লাথি মারার কোনও ষড়যন্ত্র আমরা সফল হতে দেবো না, যদি শ্রমিকদের দাবি মানা না হয়, তাহলে আমরা সভা-সমাবেশ, হরতাল সব কর্মসূচি দিতে বাধ্য হবো।’
এদিকে, অস্বচ্ছ ও গোপন চুক্তির মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার পদক্ষেপে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও চট্টগ্রাম জোনাল হেড মুহাম্মদ শাহজাহান বুধবার (১৯ নভেম্বর) এক বিবৃতি দিয়েছেন।
সংবাদ মাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর দেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র। আবার দেশের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের মতো স্পর্শকাতর ইস্যুও চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাই চট্টগ্রাম বন্দর বিষয়ে তাড়াহুড়োপ্রবণ, অস্বচ্ছ ও গোপন কোনও পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ইন্টেরিম সরকার তাই করতে চাচ্ছে। কোনও দরপত্র ছাড়াই পতিত স্বৈরাচারের আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সম্পৃক্ত এক বিদেশি কোম্পানিকে নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) তুলে দেওয়ার যাবতীয় ষড়যন্ত্র চলমান। এ ছাড়াও অন্য কয়েকটি টার্মিনালের বিষয়েও ইন্টেরিম সরকারের বর্তমান সিদ্ধান্তে জনগণের মাঝে ক্ষোভ ও ব্যাপক অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। জনআকাঙ্ক্ষার আলোকে আমরা চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে বর্তমান উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে আমাদের অবস্থান সুস্পষ্ট করে।
তিনি প্রস্তাব হিসেবে বলেন, দেশীয় ব্যবস্থায় বন্দরের উন্নয়ন সম্পন্ন করুন এবং একান্ত প্রয়োজন হলে দক্ষ ও অভিজ্ঞ বিদেশি জনবল নিয়োগ দিন এবং তাদের মাধ্যমে দেশীয় জনবলকে প্রশিক্ষিত করুন। উন্নত মানের যন্ত্রপাতিসহ যাবতীয় উপায়-উপকরণ নিয়ে আসুন। তাও যদি সম্ভব না হয়, তাহলে বিদেশি অপারেটরকে দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে অবশ্যই আন্তর্জাতিক দরপত্রের নীতিমালা অনুসরণ করে জনগণকে অবহিত করেই চুক্তি করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দর কোনও বিদেশিদের হাতে দেওয়া হচ্ছে না। তবে টার্মিনাল পরিচালনার জন্য অপারেটর নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। আমরা বার বার বিষয়টি বলে আসছি। তবে এনসিটির বিষয়ে কখন চুক্তি হবে তা এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকার কেরানীগঞ্জের পানগাঁও নৌ টার্মিনাল গত এক যুগ ধরে চট্টগ্রাম বন্দর লোকসান দিয়ে আসছে। ওপেন টেন্ডারের মাধ্যমে একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে এ টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা যদি পানগাঁও টার্মিনালকে লাভজনক পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে তাহলে এটা হবে দেশের লাভ।’
















