২০২৪ সালের ১৬ জুলাই। এ দিনটিতে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে সারা দেশের মতো বন্দর নগরী চট্টগ্রামের মুরাদপুরে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীসহ সাধারণ লোকজন। এ সময় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সন্ত্রাসীদের দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে তিন জন নিহত ও গুলিবিদ্ধ ৩০ জনসহ আহত হন অন্তত দুই শতাধিক শিক্ষার্থীসহ সাধারণ লোকজন। আহতদের চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে তিন জনকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
নিহতরা হলেন- মো. ওমর ফারুক (৩২), ওয়াসিম আকরাম (২৩) ও ফয়সাল আহমেদ শান্ত (২৪)। এর মধ্যে ফারুক স্থানীয় একটি ফার্নিচার দোকানের কর্মচারী এবং কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার মো. দুলালের ছেলে। ওয়াসিম আকরাম চট্টগ্রাম কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ও কলেজ শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক। তিনি কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার মেহেরনামা গ্রামের শফিউল আলমের ছেলে। ফয়সাল আহমেদ শান্ত চট্টগ্রামের ওমরগণি এমইএস কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্র। এ ছাড়া আহত অবস্থায় ৫০ জনকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন, পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী ওই দিন বিকাল ৩টা থেকে নগরীর ষোলশহর স্টেশনের সামনে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালনের কথা কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের। এর আগেই ষোলশহর স্টেশন দখল করে রাখেন ছাত্রলীগ-যুবলীগের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। আন্দোলনকারীরা মুরাদপুরে অবস্থান নেন। বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাকর্মীরা ষোলশহর থেকে মিছিল নিয়ে মুরাদপুরে গেলে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষ বাঁধে। এ সময় পুলিশ রাবার বুলেট ও টিয়ারশেল ছোড়ে। এতে তিন জন নিহত ও দুই শতাধিক আহত হন।
সেদিনের ১৬ জুলাইয়ের স্মৃতি মনে করে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক রাসেল আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা নগরীর ষোলশহর এলাকায় কর্মসূচি পালন করে আসছি। ১৬ জুলাইয়ের কর্মসূচি ষোলশহরে করার সময় নির্ধারণ করি। ষোলশহর, মুরাদপুর দুই দিকে জমায়েতকে শক্তিশালী করা হয়। সেখানে পুলিশের প্রটোকলে ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ তাদের সন্ত্রাসীরা আমাদের ওপর হামলা করে। একপর্যায়ে তারা গুলি করে এতে আমাদের তিন জন ভাই শাহাদাত বরণ করেন। আমরা ওইখান থেকে শুনেছিলাম রংপুরে আবু সাঈদ ভাই শাহাদাত বরণ করেছেন। সে দিনের বিভীষিকাময় ঘটনাগুলো এখনও আমাদের মনে হলে শরীর শিউরে ওঠে।’
গত বছরের ১৬ জুলাই নিহত মো. ওমর ফারুক, ওয়াসিম আকরাম ও ফয়সাল আহমেদ শান্তর পরিবারের সদস্যরা এখনও স্বজন হারানোর কথা মনে করে কাঁদেন। এখনও শোক বিরাজ করছে পরিবারের সদস্যদের মাঝে।
মো. ওমর ফারুক
স্বামীকে হারিয়ে যেন অন্ধকার নেমে এসেছে ফারুকের স্ত্রী সীমা বেগমের মাঝে। তার সংসারে রয়েছে ১৩ বছরের একটি ছেলে ও ৮ বছরের একটি মেয়ে। সীমা বেগম এখনও স্বামীর স্মৃতি ভুলতে পারেননি। স্বামীর কথা মনে করে এখনও কাঁদেন। নিহত ফার্নিচার দোকান কর্মচারী মো. ফারুকের বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের সৈয়দপুর গ্রামে। বিয়ের পর থেকে তিনি কুমিল্লার চান্দিনার বাতাঘাসি ইউনিয়নের হাসিমপুর গ্রামে শ্বশুরবাড়িতে থাকতেন। চট্টগ্রামে ফার্নিচার দোকানে কাজ করে সচল রেখেছিলেন সংসারের চাকা। ওই দিন বিকেল ৩টার দিকে দোকান থেকে চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে ভাত খাওয়ার জন্য যাচ্ছিলেন ফারুক। পথে আন্দোলনকারী, পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।
এ ঘটনায় গত ২৮ আগস্ট নগরের পাঁচলাইশ থানায় বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন নিহত ফারুকের বাবা মো. দুলাল। মামলায় সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, রাউজানের সাবেক এমপি এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীসহ ২৬৯ জনকে আসামি করা হয়েছে। পাশাপাশি অজ্ঞাত আরও ৪০ থেকে ৫০ জনকে আসামি করা হয়।
ওয়াসিম আকরাম
কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার দক্ষিণ মেহেরনামা এলাকার বাসিন্দা ওয়াসিম আকরাম। দুই ভাই তিন বোনের মধ্যে তৃতীয় তিনি। তার বাবা সৌদিপ্রবাসী শফিউল আলম ও মা জোসনা বেগম। তিনি ২০১৭ সালে কক্সবাজারের পেকুয়া সদর ইউনিয়নের মেহেরনামা উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ২০১৯ সালে বাকলিয়া সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। পরে তিনি চট্টগ্রাম কলেজে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে অনার্সে ভর্তি হন। ওয়াসিম চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন।
ওয়াসিম আকরামের মা জোসনা বেগম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার ছেলে ওয়াসিম লেখাপড়ায় অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। আমার ছেলেকে যারা নির্মমভাবে হত্যা করেছে আমি তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।’
ওয়াসিম নিহতের ঘটনায় গত ১৮ আগস্ট নগরীর পাঁচলাইশ থানায় মা জোসনা বেগম বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১০৮ জন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীর নাম উল্লেখ করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় অজ্ঞাতনামা আরও ১০০ থেকে ১৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
ফয়সাল আহমেদ শান্ত
ফয়সাল আহমেদ নগরের ওমরগণি এমইএস কলেজের স্নাতক প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন। তিনি বন্দর থানার ফ্রিপোর্ট এলাকায় ভাড়া বাসায় পরিবারসহ থাকতেন। তার গ্রামের বাড়ি বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার রহমতপুর ইউনিয়নের মহিষাদী গ্রামে। তিনি একই গ্রামের জাকির হোসেন ও মা কহিনূর আক্তারের ছেলে। ফয়সাল পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনি করে হাত খরচ চালাতেন। সংঘর্ষের দিন বিকালে টিউশনি করার জন্য বাসা থেকে বের হয়েছিলেন শান্ত। পথে সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে গুলিবিদ্ধ হন। তার শরীরে তিনটি গুলির চিহ্ন পাওয়া গেছে।
চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশ থানা এলাকায় ফয়সাল আহমেদ শান্ত নিহত হওয়ার ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ করা হয়েছে। ২১ আগস্ট ভুক্তভোগীর বাবা মো. জাকির হোসেন বাদী হয়ে এ অভিযোগ করেন। এতে প্রধান আসামি করা হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। এ ছাড়া অভিযোগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক আবদুল্লাহ আল মামুন, ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেনসহ ৭৭ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয় ১ হাজার থেকে ১২০০ জনকে।













