ভারতে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ অন্তত: ২৫ জনের বিরুদ্ধে গুম করার অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।
হত্যা, গণহত্যা তথা মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে শেখ হাসিনা ও তার দোসরদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা হলেও গুমের অভিযোগে মামলা করা হলো এই প্রথম।
গতকাল সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ অভিযোগ দায়ের করেন রাজধানীর বাসাবোর ব্যবসায়ী এনামুল কবির। তিনি ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সংঘটিত সকল গুমের তদন্ত চেয়েছেন।
এনামুল কবির ২০১৮ সালের ১০ দিন গুম ছিলেন। এ তথ্য জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চীফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।
ব্যবসায়ীর দায়েরকৃত অভিযোগ সম্পর্কে মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, ২০১৮ সালের ১৭ নভেম্বর বাসাবোর অফিস থেকে এনামুল কবির নামের এক ব্যবসায়ীকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নেয়া হয়।
তৎকালিন ডিবি কর্মকর্তা মশিউরের নির্দেশে তুলে নেয়া হয় তাকে। চোখ বন্ধ করে হাত-পা বেঁধে আটকে রাখা হয়। পরে ২৬ নভেম্বর একটি মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে কোর্টে তোলে।
অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, ওই ব্যবসায়ীকে নির্যাতন করে বিরোধী তথা জামায়াতের তথ্য জানতে চায়। তার অফিস থেকে বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়েছে মর্মে মামলা করে।
অনেক দিন কারাভোগের পর তিনি জামিন লাভ করেন। এ বিষয়ে অভিযোগ এনে তিনি শেখ হাসিনাসহ ২৫ জনের নাম উল্লেখ করেছেন। পাশাপাশি বিগত সরকারের ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত গুমের ঘটনারও তদন্ত চেয়েছেন। আমরা এখন এটি যাচাই-বাছাই করে দেখবো।
উল্লেখ্য, জুলাই-আগস্ট গণহত্যার দায়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া আওয়ামী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানাসহ শেখ পরিবারের সব সদস্যের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ দায়ের হচ্ছিলো। কিন্তু গুমের অভিযোগ শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা এটিই প্রথম।
এর আগে গত ২৭ আগস্ট তদন্ত কমিশন গঠন করে সরকার। সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত এই কমিশনের অন্য সদস্যরা হলেন হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত বিচারপতি মো: ফরিদ আহমেদ শিবলী, মানবাধিকারকর্মী নূর খান,ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নাবিলা ইদ্রিস ও মানবাধিকারকর্মী সাজ্জাদ হোসেন।
গঠিত এ কমিশন গুমের শিকার ব্যক্তিদের তথ্য-উপাত্ত চেয়ে গত ১২ সেপ্টেম্বর গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে। বিজ্ঞপ্তি অনুসারে আগামি ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কমিশন এ সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহের কথা রয়েছে।
কমিশন কর্মকর্তা ও অতিরিক্ত জেলা জজ মো: বুলবুল হোসেন তথ্য চেয়ে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেন। কমিশন সংক্রান্ত গণবিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়,
২০১০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে গত ৫ আগস্ট পর্যন্ত দেশের আইনশৃঙ্খলা প্রয়োগকারী সংস্থার (পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, সিআইডি, বিশেষ শাখা, গোয়েন্দা শাখা, আনসার ব্যাটালিয়ন, এনএসআই, ডিজিএফআই, কোস্টগার্ড) কোনো সদস্য দ্বারা গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধানে সরকার এই কমিশন গঠন করেছে।
গণবিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, গুমের ঘটনায় ভুক্তভোগী নিজে অথবা পরিবারের কোনো সদস্য বা আত্মীয়স্বজন বা গুমের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী যেকোনো ব্যক্তি অভিযোগ দাখিল করতে পারবেন।
সশরীর কমিশনের কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে, ডাকের মাধ্যমে অথবা কমিশনের ই-মেইলে লিখিতভাবে অভিযোগ করতে পারবেন।
১৫ থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রত্যেক কর্মদিবসে সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত এই অভিযোগ করা যাবে।
এ সময়ে অভিযোগ দাখিলের জন্য হটলাইনের মাধ্যমে আগেই সময় নেয়ার (অ্যাপয়েন্টমেন্ট) জন্যও অনুরোধ করেছে তারা। রাজধানীর ৯৬, গুলশান এভিনিউতে কমিশন কার্যালয় অবস্থিত।
প্রতিটি অভিযোগনামায় অন্যান্য তথ্যসহ গুমের ঘটনার সুনির্দিষ্ট বিবরণ, ঘটনার স্থান, তারিখ ও সময়, অভিযোগকারী ও তাঁর বাবা–মায়ের নাম, ভুক্তভোগীর নাম ও তার বাবা–মায়ের নাম, ভুক্তভোগীর সঙ্গে অভিযোগকারীর সম্পর্ক, অভিযোগকারী ও ভুক্তভোগীর ডাক-ঠিকানা, মোবাইল নম্বর, ই- মেইল ও অভিযুক্ত বা সন্দেহভাজন ব্যক্তি বা সংস্থার নাম-ঠিকানা ইত্যাদি অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে।
অভিযোগনামায় বর্ণিত গুমের ঘটনার সমর্থনে পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণাদি, সাক্ষীদের নাম-ঠিকানার তালিকাসহ অভিযোগকারী ও ভুক্তভোগীর জাতীয় পরিচয়পত্র (যদি থাকে) দাখিলের জন্য অনুরোধ করা হয়।
এই কমিশন পরে প্রয়োজনবোধে অভিযোগ দাখিলকারী ও অভিযুক্ত ব্যক্তি বা তার প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করবে এবং কার্যক্রম গ্রহণ করবে।
সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাগুলোর সঙ্গে পৃথকভাবে যোগাযোগ করে এই কমিশন প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ ও সহায়তা গ্রহণের উদ্যোগ নেবেন বলেও উল্লেখ করা হয় বিজ্ঞপ্তিতে।
এদিকে গত ১২ অক্টোবর তদন্ত কমিশনের কাছে গুম হওয়া ৬৪ জনের তালিকা পাঠিয়েছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে তদন্ত কমিশনের কাছে সুপারিশ করেন প্রধান বিচারপতি।
গুম হওয়া ৬৪ ব্যক্তির তথ্য-উপাত্ত বিষয়ে সুপ্রিমকোর্ট কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে জানানো হয়,বিভিন্ন সময়ে আইন শৃঙ্খলা প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক জোরপূর্বক গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনগণ
‘গুম পরিবারের সদস্য’ এর ব্যানারে গত ২৮ আগস্ট প্রধান বিচারপতির নিকট একটি স্মারকলিপি প্রদানের জন্য আসেন। সুপ্রিমিকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল আজিজ আহমেদ ভুইঞা স্মারকলিপিটি গ্রহণ করেন।
স্মারকলিপিতে গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের স্বজন ও তাদের পরিবারের সদস্যবৃন্দের আর্থিক ও মানসিক দুর্দশার বিবরণের পাশাপাশি গুমের অপরাধ সংঘটনকারী ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক অপরাধ বিচারের ব্যবস্থা গ্রহণ, গুমের শিকার পরিবারকে আর্থিক ক্ষতিপূরণের নির্দেশ প্রদান, সরকারি খরচে মামলা পরিচালনার সুযোগ প্রদান ও গুম হওয়া ব্যক্তির সন্ধান না পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সম্পত্তি বিক্রয় বা হস্তান্তরের নিমিত্ত বিশেষ সনদ সপ্রদানসহ ৮টি বিষয়ে প্রধান বিচারপতির সহযোগিতা কামনা করা হয়।
গুম হওয়া ব্যক্তির পরিবারের সদস্যদের প্রধান সমন্বয়ক আলহাজ্ব মো: বেল্লাল হোসেন স্বাক্ষরিত এই স্মারকলিপিতে আওয়ামী সরকার আমলে গুম হওয়া ৬৪ ব্যক্তির ছবি ও নাম, ঠিকানা সম্বলিত তালিকা দেয়া হয়। প্রধান বিচারপতি ওই তালিকা পাঠিয়ে দেন গুম কমিশনে।