রংপুরের গঙ্গাচড়ায় মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে কটূক্তির অভিযোগে গ্রেফতার এক কিশোরের বাড়িসহ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বসতঘরে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনার পর এখন ওই এলাকায় আতঙ্ক কিছুটা কমেছে। আতঙ্কে যেসব পরিবার অন্যত্র গেছে, তারা বাড়িঘরে ফিরতে শুরু করেছে। তবে তাদের ভয় এখনও পুরোপুরি কাটেনি। এরই মধ্যে উপজেলা প্রশাসনের সহায়তায় ক্ষতিগ্রস্ত ঘরগুলো মেরামত শুরু হয়েছে।
গত শনিবার রাতে ও রবিবার বিকালে উপজেলার আলদাদপুর নতুন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও আলদাদপুর দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের আশপাশে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘরে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।
ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর ঘরবাড়ি মেরামত
মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) দুপুরে সরেজমিনে দেখা গেছে, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর ঘরবাড়ি মেরামত করা হচ্ছে। আলদাদপুর নতুন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে ও ভেতরে অবস্থান করছে সেনাবাহিনী। কাছাকাছি খিলালগঞ্জ বাজারেও পুলিশ ও সেনাসদস্যদের টহল দিতে দেখা গেছে। সেনাবাহিনী ও পুলিশ কঠোর অবস্থান নেওয়ায় এলাকায় হিন্দুদের মাঝে আতঙ্ক কিছুটা কমেছে বলে জানিয়েছেন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন।
স্থানীয় ইউপি সদস্য পরেশ চন্দ্র বলেন, সোমবার রাত ১২টার দিকে জেলা প্রশাসক রবিউল ফয়সাল, পুলিশ সুপার আবু সাইম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। তারা ক্ষতিগ্রস্ত বসতঘরে মেরামতের জন্য আজ সকালে টিন ও কাঠ পাঠিয়েছেন। সকাল থেকে ৩০ জন কাঠমিস্ত্রি মেরামতের কাজ করছেন।
গঙ্গাচড়া উপজেলার আলদাদপুর গ্রামটি হিন্দু-অধ্যুষিত। এটি নীলফামারী উপজেলার কিশোরগঞ্জের সীমানা লাগোয়া। গঙ্গাচড়া থানা সূত্রে জানা যায়, গত শনিবার এই গ্রামের এক কিশোর ফেসবুকে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে অবমাননাকর লেখা ও ছবি দিয়েছে, এমন অভিযোগ পায় পুলিশ। পরে অভিযোগের সত্যতা পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে তাকে আটক করে শনিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে থানায় আনা হয়। সাইবার সুরক্ষা আইনে মামলা করে পরদিন দুপুরে আদালতের মাধ্যমে সম্মিলিত শিশু পুনর্বাসন কেন্দ্রে পাঠানো হয়।
পুলিশ ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ওই কিশোরকে থানায় নেওয়ার পর তার বিচারের দাবিতে মিছিলসহ উত্তেজিত লোকজন শনিবার তার বাড়ির সামনে যায়। রাত ১০টার দিকে দ্বিতীয়বার আরেকটি মিছিল এসে কিশোরের এক স্বজনের বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর করে। পরে রাতে থানা পুলিশ ও সেনাবাহিনী গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। রবিবার বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে উত্তেজিত জনতা বাড়িঘরে হামলা শুরু করলে পুলিশ তাদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় কয়েকটি বাড়িঘর ভাঙচুর করা হয়। এতে পুলিশের একজন কনস্টেবলকে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
গ্রেফতার যুবকের পরিবার বাড়ি ফিরেনি
মঙ্গলবার সরেজমিনে দেখা যায়, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহমুদ হাসান মৃধার তত্ত্বাবধানে ভাঙচুর হওয়া ঘরবাড়ি মেরামত করে দেওয়া হচ্ছে। সরকারের অর্থায়নে নতুন টিনসহ অন্যান্য সরঞ্জাম দিয়ে ঘরের বেড়া ও চাল লাগানোর কাজ চলছে। ইউএনও এসব কাজ তদারকি করছেন। এরই মধ্যে বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় যারা প্রতিবেশী ও স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাদের কয়েকজন নিজেদের বাড়িতে ফিরতে শুরু করেছেন। তারাও মিস্ত্রিদের ঘরের কাজে সহযোগিতা করছেন। তবে গ্রেফতার যুবকের পরিবার এবং চাচাদের পরিবার এখনও বাড়িতে ফিরেনি। তারা স্বজনদের বাড়িতে আছেন বলে জানা গেছে।
ইউএনও মাহমুদ হাসান মৃধা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের নেতারা গ্রেফতার যুবকের পরিবার এবং স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেছেন। বাড়িঘর মেরামত হয়ে গেলে তারা বুধবারের মধ্যে ঘরে ফিরবেন। ওই যুবকের বাবা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। তিনি সুস্থ আছেন। বাসায় আসবেন বুধবার।’
২২টি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত
ইউএনও মাহমুদ হাসান মৃধা জানিয়েছেন, মোট ২২টি ঘরে ভাঙচুর চালানো হয়। এর মধ্যে ছয়টি ঘর পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছ। বাকিগুলোর টিনের বেড়াসহ অন্যান্য জিনিস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আজকের মধ্যে সবগুলো ঘর নতুনভাবে মেরামত হয়ে যাবে। এ ছাড়া একটি পরিবার বলেছেন, তাদের টিউবওয়েল নেই। সেটিও বসিয়ে দেওয়া হবে। তাদের নিরাপত্তার জন্য যা যা করার করা প্রয়োজন, সবই করবে প্রশাসন।
মাহমুদ হাসান বলেন, ‘এখন পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক আছে। এলাকায় কোনও আতঙ্ক নেই। কেউ কেউ হয়তো ভয় পাচ্ছেন। সেটিও দু’একদিনের মধ্যে কেটে যাবে। পুলিশ ও সেনাবাহিনী এখনও ঘটনাস্থলে আছে। আতঙ্কের কোনও কারণ দেখছি না আমরা। পাশাপাশি যারা এই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করেছে এবং ভাঙচুরের সঙ্গে জড়িত, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। আমরা হিন্দু-মুসলিম কাঁধে কাঁধ রেখে আগের মতো এখানে বসবাস করবো। যে ঘটনাটি ঘটেছে, সেটি অনাকাঙ্ক্ষিত। এখানের লোকজনও তাই বলছেন।’
ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা
ইতিমধ্যে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করেছে উপজেলা প্রশাসন। তালিকায় দেখা গেছে, ধরনী কান্ত রায়ের ঘরের চারটি টিনের বেড়া; ধনঞ্জয় রায়ের ঘরের দুটি টিনের বেড়া, একটি শোকেস, একটি আলনা; সুশান্ত চন্দ্রের ঘরের একটি টিনের বেড়া, একটি আলনা, একটি টিভি, একটি শোকেস; কমলাকান্ত রায়ের ঘরের একটি বেড়া, একটি শোকেস; সুবল চন্দ্রের ঘরের একটি বেড়া, পাঁচ বস্তা ধান, পাঁচটি চেয়ার; মনোরঞ্জন রায়ের ঘরের পাঁচটি জানালা, বাড়ির লোহার গেট; রবিন চন্দ্রের দুটি খাট, দুটি আলমারি, দুটি শোকেস; কেশব চন্দ্রের পাকা বাড়ির দেয়াল, ঘরের আসবাবপত্র; জয় চাঁদের ঘরের দুটি টিন, আসবাবপত্র; সুজন চন্দ্রের ঘরের দুটি বেড়া, আসবাবপত্র; বিনয় মোহন্তের ঘরের দুটি টিনের বেড়া, ঘরের আসবাবপত্র; লাল মোহনের ঘরের একটি টিনের বেড়া এবং অবিনাশ রায়ের ঘরের একটা টিনের বেড়া লুটপাট ও ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে। এ ছাড়াও জয়ন্ত কুমারের দুটি ছাগল; প্রমোদ মোহন্তের আলমারি ভেঙে ৩০ হাজার টাকা, এক ভরি সোনা এবং কয়েকজন হিন্দু পরিবার তাদের স্বর্ণ এবং টাকা লুটের অভিযোগ করেন জেলা প্রশাসনের কাছে।
যা বলছেন ক্ষতিগ্রস্তরা
হামলার শিকার পরিবারগুলো বলছে, বাড়িঘর ভাঙচুরের পাশাপাশি তাদের মালামাল লুট হয়েছে। এখনও সেগুলো ফেরত পাননি তারা।
ধরনী কান্ত রায় বলেন, ‘যা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেগুলো মেরামত করে দিচ্ছে প্রশাসন। মিস্ত্রি দিয়ে ঘরগুলোর টিন লাগিয়ে দিচ্ছে। জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা এসেছেন। আমাদের খোঁজখবর নিয়েছেন। নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছেন। এই কয়দিন আমরা খুব আতঙ্কে ছিলাম। এখন মোটামুটি আতঙ্ক কিছুটা কমেছে।’
ধনঞ্জয় রায় বলেন, ‘সেদিন যারা আমাদের বাড়িঘর ভাঙচুর করেছে, তারা আমাদের এলাকার লোক নয়। সবাই পাশের জেলা নীলফামারীর কিশোরগঞ্জের লোক। তারা এখানে এসে লুটপাট করে চলে গেছে। আমরা খুব ভয় পেয়েছিলাম। এখন সেনাবাহিনী, পুলিশ ও প্রশাসন আমাদের নিরাপত্তা দিচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি ঠিক করে দিচ্ছে তারা। এখানে আমরা হিন্দু-মুসলমান মিলিমিশে বসবাস করি সবসময়। এখানের মুসলমানরা আমাদের ওপর আগে কখনও হামলা করেনি। সেদিন বাইরের লোকজন এসে হামলা করে চলে যায়।’
নারায়ণ মোহন্ত বলেন, ‘সোমবার জেলা প্রশাসকসহ অনেকে এসে আমাদের অবস্থা দেখে গেছেন। মঙ্গলবার সকাল থেকে ক্ষতিগ্রস্ত ঘরগুলোর মেরামত কাজ শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে আতঙ্কে যারা বাড়িঘর ছেড়ে গেছেন, তারা ঘরে ফিরেছেন। দু’চারটি পরিবার ছাড়া কেউ এলাকার বাইরে নেই। তারাও দু’একদিনের মধ্যে চলে আসবেন। এখন এলাকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক। আমরা এখানে মিলেমিশে বসবাস করতে চাই।’
আলদাদপুর হিন্দুপল্লির মন্দিরের পুরোহিত বলরাম সাধু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শনিবার ঘটনার দিন রাতে এলাকার প্রায় সব মুসলিম, পুলিশ এবং সেনাবাহিনী হামলা প্রতিরোধ করেছিল। পুলিশ এবং সেনাবাহিনী চলে গেলে পরদিন বিকালে পাশের জেলা থেকে লোকজন জড়ো করে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। এলাকার লোকজন চেষ্টা করেও তা ঠেকাতে পারেননি। পুলিশ ও সেনাবাহিনী যদি ঘটনাস্থল ত্যাগ না করতো, তাহলে রবিবার হামলার ঘটনা ঘটতো না। গতকাল ও আজকে স্থানীয় মুসলিম কমিউনিটি এবং পুলিশ ও প্রশাসনের তৎপরতায় আমাদের আতঙ্ক কিছুটা কমেছে। গত দুদিনের মতো সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকলে কেউ এখানের হিন্দুদের কোনও ক্ষতি করতে পারবে না।’
ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি
হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের গঙ্গাচড়া উপজেলার আহ্বায়ক তপন কুমার রায় বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রবিবার যদি সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে থাকতো তাহলে কোনোভাবেই হামলার ঘটনা ঘটতো না। যাইহোক পরবর্তী সময়ে পুলিশ, সেনাবাহিনী এবং প্রশাসন যে উদ্যোগ নিয়েছে; তাতে আমরা সন্তুষ্ট। এখানের সব পরিবারের সঙ্গে কথা বলে আতঙ্ক কাটানোর চেষ্টা করছি আমরা। পাশাপাশি ঘটনায় জড়িত সবাইকে গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। সেইসঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।’
ঘটনাস্থল পরিদর্শন প্রশাসনের
সোমবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রবিউল ফয়সালের নেতৃত্বে জেলা এবং উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা। তাদের কাছে নিরাপত্তার জন্য একটি স্থায়ী পুলিশ ক্যাম্পের দাবি জানান হিন্দুপল্লির লোকজন। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ পুলিশ ক্যাম্প স্থাপনের আশ্বাস দেন জেলা প্রশাসক। তিনি বলেছেন, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সহযোগিতা করা হবে। তাদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেবে প্রশাসন।
দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে নেওয়া হবে কঠোর ব্যবস্থা
রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্তরা এখনও মামলা দেয়নি। মামলা দেওয়া মাত্রই নেওয়ার হবে। দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবো আমরা। বাংলাদেশ হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতির জায়গা। সেই জায়গায় যারা আঘাত হানার চেষ্টা করবে, তাদের ছাড় দেবো না আমরা।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহমুদ হাসান মৃধা বলেন, ‘জেলা পুলিশ সুপার আবু সাইম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। হামলার সঙ্গে নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার মাগুরা ইউনিয়নের লোকজন সম্পৃক্ত বলে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। পুলিশ ও সেনাবাহিনী মোতায়েন আছে, যাতে তারা আবার ঢুকতে না পারে। ক্ষতি বা লুটপাটের তালিকা করেছি আমরা। তাদের আর্থিক বা অন্যান্য সহযোগিতা দেওয়া হবে।’